বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জীবনী। “আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর…” মহালয়ার ভোরে এই ধ্বনিতে ঘুম ভাঙার জন্য সারাটা বছর অপেক্ষা করে থাকে আপামর বাঙালি। সেই ১৯৩১ সাল থেকে বেতারে যার সম্প্রচার শুরু, আজ এতগুলো বছর পেরিয়েও যার জনপ্রিয়তা এতটুকু কমেনি। তিনি হলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র , বাচিক শিল্পী হিসাবেই শুধু নয়, একাধারে বেতার সম্প্রচারক, গায়ক, নাট্যকার, অভিনেতা ও নাট্য পরিচালকও ছিলেন।
মহিষাসুরমর্দিনী-র বেতার গীতি আলেখ্যতে চণ্ডীপাঠ করে অমরত্ব লাভ করেছেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯২৮-এ ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের সদর দফতরে যোগদানের মধ্য দিয়ে। চাকরি করলেও তাঁর মন পড়ে থাকত ১ নম্বর গার্স্টিন প্লেসের বেতার কেন্দ্রে। তাই টিফিনের সময়ে বা বিকেলে ছুটির পরে তিনি পৌঁছে যেতেন রেডিয়োর বন্ধুদের আড্ডায়। এই আসর থেকে ধীরে ধীরে বেতার নাটকে সুযোগ পেয়ে গেলেন তিনি। প্রথমবারেই তাঁর পরিচালিত নাটকে অভিনয় করলেন বাণীকুমার ভট্টাচার্য, পঙ্কজ মল্লিক, পশুপতি চট্টোপাধ্যায়।
১৯২৮ সালের ২৬ আগস্ট বেতারে সম্প্রচারিত হল ‘চিকিৎসা সংকট’। তাঁর অনুরোধেই ১৯২৮ সালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ রেডিয়োতে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে তিনি যোগ দেওয়ার পর থেকে দেবী দুর্গার পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে দু’ ঘণ্টার সঙ্গীতালেখ্য মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হন। এই অনুষ্ঠানটির ভাষ্য লিখেছিলেন বাণীকুমার ভট্টাচার্য। সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন রাইচাঁদ বড়াল এবং পঙ্কজকুমার মল্লিক। পরবর্তীতে পঙ্কজ মল্লিক সঙ্গীত পরিচালনার ভার একাই সামলাতেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভাষ্য ও শ্লোকপাঠ করেন। প্রথম দিকে বেশ কয়েক বছর ষষ্ঠীর দিন ভোরে অনুষ্ঠিত হত। পরে মহালয়ার দিন ভোরে শোনানো শুরু হয়। প্রথম দিকে টেপরেকর্ডিং করা অনুষ্ঠানের চল ছিল না। আকাশবাণী-তে সব অনুষ্ঠানই হত সরাসরি সম্প্রচারিত। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’তে যাঁরা অংশ নিতেন তাঁরা অনেকেই আগে মহড়ার জন্য চলে আসতেন বেতারে।
তবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ আগের দিন রাতে রেডিও স্টেশনে থেকে যেতেন। ১৯৩১ সালের ৮ মে বেতারে অভিনীত হল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘সাজাহান’ নাটক। তিনি ছিলেন ঔরঙ্গজেবের ভূমিকায়৷ তাঁর প্রথম পরিচালিত নাটক ‘অভিষেক’ রঙমহলে মঞ্চস্থ হয়৷ বেতারে অভিনয় করলেও মঞ্চে তিনি অভিনয় করেননি৷ ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের শেষ যাত্রার ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন তিনি৷ উত্তমকুমারের শেষ যাত্রার ধারাবিবরণীও দিয়েছিলেন। আকাশবাণী-র নিজস্ব একটা কাগজ ছিল নাম ‘বেতারজগৎ’। ‘বেতারজগৎ’ ছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণের প্রাণ। একবার সরকারের পক্ষ থেকে বন্ধ করে দেওয়া হল সেই কাগজ। তখন তিনি জি পি ও-র সামনে ভরা শীতে আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ‘বেতারজগৎ’ বিক্রি করতেন।
আরও পড়ুন – ট্যাবলেটে দুর্গা মুর্তি বানিয়ে জাতীয়স্তরে পুরস্কৃত হল বীরভূমের প্রসেনজিৎ
১৯৭৬ সালে আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ ঠিক করলেন চিরাচরিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বীরেন্দ্রকৃষ্ণর বদলে উত্তমকুমারকে দিয়ে করাবেন, বাদ পড়লেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। সেই অনুষ্ঠান চরম ব্যর্থ হল। বেতার অফিস ভাঙচুর হয়েছিল৷ বহু মানুষের চাহিদায় ষষ্ঠীর দিন আবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণর মহিষাসুরমর্দিনী সম্প্রচার করা হয়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের জীবনের শেষ সময়টা মোটেই সুখকর ছিল না৷ স্টাফ আর্টিস্ট হয়ে অবসর নিয়েছিলেন তিনি ফলে পেনশন জোটেনি। অবসরের পরে শেষ পর্যন্ত ‘মহাভারতের কথা’ বলার জন্য সামান্য টাকা পেতেন। ক্রমশ স্মৃতিভ্রংশ হয়ে আসছিল তাই সেই অনুষ্ঠানও চালানো যায়নি৷ শেষ পর্যন্ত অর্থাভাব মেটাতে পাড়ায় পাড়ায় অনুষ্ঠান উদ্বোধন করে বেড়াতেন তিনি। এমনকি অবসর নেওয়ার পর একদিন আকাশবানীতে এলে তাকে ভিতরে ঢুকতেও দেওয়া হয় না।