এখানে মানবী মায়ের চোখের জল মোছাতে চিন্ময়ী দেবী মায়ের আরাধনা শুরু হয়। নন্দকুমারের ব্যবত্তারহাটের প্রাণের আদি ও প্রাচীন পুজো এটি। আগের সেই পুরনো জমিদার আমলের দুর্গা মণ্ডপ ভেঙে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তার জায়গায় তৈরি হয়েছে নতুন দুর্গা মন্ডপ।
পুজোর ক’দিন পরিবারের সবাই দূর-দূরান্ত থেকে এসে উপস্থিত হন। পুজোর ক’দিনে আশপাশের কয়েক হাজার মানুষের জন্য ভোগের ব্যবস্থা হয়। কিন্তু গত বছর থেকে করোনার কারণে সেই ভোগ খাওয়ানো বন্ধ। বন্ধ ফুল দিয়ে পুষ্পাঞ্জলি। শুধুমাত্র করজোড়ে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করেন এলাকার মানুষ। “এ বছরেও তার অন্যথা হবে না। বলে জানান এই বাড়িরই এক সদস্য। প্রায় ৩৫০ থেকে ৪০০ বছরের প্রাচীন পুজো বলেই এটি পরিচিত। এই পুজো প্রথম প্রচলন করেছিলেন এই পরিবারের পূর্বপুরুষ সার্থকরাম। স্বার্থকরাম ছিলেন তাম্রলিপ্ত অধুনা তমলুকের রাজা তাম্রধ্বজ রাজার রাজপরিবারের ব্যবস্থাপক। এই ব্যবস্থাপক থেকেই এই এলাকার নাম হয় ব্যবত্তারহাট।
তবে আর প্রতিটা প্রাচীন বনেদি বাড়ির দুর্গা পুজোর ইতিহাসের মত নয় এর ইতিহাস। এই পুজোর ইতিহাস সম্পূর্ণ আলাদা। মানবী মায়ের চোখের জল মোছাতে চিন্ময়ী দেবী মায়ের আরাধনা শুরু হয়। আজ প্রায় ৩৫০ থেকে ৪০০ বছর আগে দুঃখী মায়ের চোখের জল নিবারণ করতেই এই পুজো শুরু করেছিলেন স্বার্থকরাম। পাশের গ্রামে দুর্গা পুজোয় অঞ্জলি দিতে গিয়েছিলেন এই পরিবারের পূর্বপুরুষ স্বার্থকরামের মা।
স্বার্থকরামের মাকে ভিখারি বামুনের বউ বলে অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়া হয় সেখান থেকে। দেবী মায়ের কাছে অঞ্জলি দিতে না পেরে সার্থকরামের মা কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন। মায়ের চোখের জল মুছে দিতে স্বার্থকরাম পরের বছর ঘট তুলে দেবী দুর্গা মায়ের পুজো শুরু করলেন। তার সেই চোখের জল নিবারণ করতেই শুরু হয়েছিল এই দুর্গাপুজো। তার পরের বছর থেকে এদিন পর্যন্ত একচালা সাবেকি মূর্তিতে মায়ের পূজা হয়ে চলেছে।
আর ও পড়ুন ফের বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত শহর, ভেঙে পড়ল বাড়ির একাংশ
প্রায় ১২ থেকে ১৪ পুরুষ ধরে এই দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। এই পরিবারে ভট্টাচার্য ও চক্রবর্ত্তী পরিবারে মানুষ জনের বসবাস। এই বাড়ির পূর্বপুরুষের পদবী ছিল ঘোষাল ব্রাহ্মণ। তাঁদের পরবর্তী বংশধররা কেউ কেউ ভট্টাচার্য উপাধি পায়। সেই থেকেই চক্রবর্তী এবং ভট্টাচার্য পরিবারের মিলিত পুজো এই ব্যবত্তাবাটিতে। সময় এগিয়ে এলেও এখনও প্রাচীন রীতি এবং নিয়মকানুন মেনেই দেবী দুর্গার আরাধনা হয়। বাড়ির মেয়েরাই পুজোর সব কাজকর্মে হাত মেলায়।
প্রায় মাস খানেক ধরেই প্রস্তুতি চলে। মাকে নিজের হাতে তৈরি বড়ি দিয়ে ভোগ দেন এই বাড়ির মহিলারা। মায়ের ভোগের কিছু বিশেষত্ব আছে। ষষ্ঠীর দিন বিল্লঅধিবাসে এক মণ ছয় সের আতপ চালের অন্নভোগ আর নৈবেদ্যে দেওয়া হয় ছয় রকমের তরিতরকারি। সপ্তমীর দিন এক মণ সাত সের আতপ চালের অন্নভোগ সহ সব রকমের তরিতরকারি দেওয়া হয় মাকে।
মহাঅষ্টমীর দিন এক মণ আট সের আতপ চালের নৈবেদ্য ও অন্নভোগ দেওয়া হয় এবং সঙ্গে আট রকমের তরিতরকারি। সন্ধিপুজো বিশেষ রীতিনীতি মেনে হয় এবং সেখানেও অন্নভোগ খিচুড়ি ভোগ মহাপ্রসাদ দেওয়া হয়, মহা নবমীর দিন এক মণ নয়সের আতপ চালের নৈবেদ্য অন্নভোগ দেওয়া হয় এবং সাত থেকে নয় রকমের তরিতরকারি দেওয়া হয়।
দশমীর দিন মাকে দধিকর্মা দিয়ে বিদায় জানানো হয়। সন্ধের সময় মেয়েদের সিঁদুর খেলা ও বাড়ির পুরুষরা কাঁধে করে বাড়ি থেকে অনতিদূরে দুর্গা মনি পুকুরে মায়ের ভাসান সম্পন্ন করে। প্রায় হাজার খানেক প্রদীপের সলতে পাকান বাড়ির বৌ মেয়েরা। বর্তমানে প্রাচীন এই পুজোয় আড়ম্বর না থাকলেও নিষ্ঠা ভক্তির অভাব নেই এখানে। তবে করোনার জেরে এওবছরও মায়ের আরাধ্না হবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে।