কুসংস্কার ও আমাদের দৈনন্দিন জীবন। অস্বীকার করার উপায় নেই , আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাত্রার অন্যতম অঙ্গ কুসংস্কার । বিশেষ করে আমাদের বাঙালিদের জীবনে এর প্রভাব বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করা যায়। কার্যত গ্রামে যাদের ছোট বেলা কেটেছে, তাদের জীবনের সাথে একটা অংশ জুড়ে আছে কুসংস্কার । বিশেষ করে আমাদের বড়রা সেই সব কুসংস্কার আমাদের মাঝে সঞ্চালিত করেছেন । বলাই যায় যে জেনারেশন ওয়াইজ সর্কুলেট হয়েছে এই অলিখিত বিশ্বাসের ট্র্যাডিশন। ছোটবেলায় আমরা সেই সব কুসংস্কার মেনে চললেও একটু বড় হয়ে গেলেই আমরা টের পেতে শুরু করি যে আসলে এসব বিশ্বাস করার কোন মানে নেই । যদিও আমরা এমন অনেক কুসংস্কার সংস্পর্শে এসেছি । আজকে সেই সব কিছু অংশ তুলে ধরার চেষ্টা করলাম । আশা করি আপনাদের অনেকের সাথেই মিলে যাবে আজকের এই লেখনী !!
১. বেড়ালের কাছে মাফ চাওয়া : ছোট বেলায় আমাদের গলায় কাঁটা বিধে যাওয়ার খুবই কমন একটা ব্যাপার ছিল । মাছ খেতে গেলেই আমাদের অনেকের গলায় কাঁটা বিধতো ! বেশির ভাগ সময়ে দেখা যেত যে খালি ভাত গিললে সেই কাঁটা চলে যেত । তবে কিছু কিছু দিন কোন ভাবেই সেই কাঁটা যেত না । তখন নানান ফন্দিফিকির করতে হত । তার ভেতরে একটা হচ্ছে বেড়ালের কাছে মাফ চাওয়া । কারণ হিসাবে বলা হত যে কাঁটা হচ্ছে বেড়ালের খাবার । আমি সেই খাবার খেয়ে বেড়ালের প্রতি অন্যায় করেছি । তাই তার কাছে মাফ চাইতে হবে ।
২. জোড়া কলা : কলা আমাদের অনেকের পছন্দের একটা ফল । আমরা অনেকেই ছোট বেলা থেকেই নিয়মিত কলা খাই । তবে ছোট বেলা থেকেই আমাদের শেখানো হয়েছে যে জোড়া কলা খেতে নেই । এই জোড়া কলা খেলে নাকি জমজ সন্তান হবে ! যমজ বাচ্চা হবে, এটা আমাদের কাছে তখন অদ্ভুত লাগতো । তাই সব সময় জোড়া কলা এড়িয়ে চলতাম !
৩. চায়ের পরে জল খেলে দাঁত পড়ে যায় : সব কিছু খেয়েই আমাদের জল খাওয়ার একটা অভ্যাস আছে । কিন্তু চায়ের পরে জল খেতে গেলেই আমাকে শুনতে হত যে চায়ের আগে জল খেতে হয়, চা খাওয়ার পরে জল খেলে দাঁত পড়ে যায় । একটু বড় হলে আমরা ঠিক ঠিক বুঝে গেলাম যে আসলে চায়ের আগে কিংবা পরে জল খেলে দাঁতের কিছুই হয় না । তবে আগে জল খাওয়া ভালো। সেই তখন থেকেই আমরা সব সময় চা খাওয়ার আগেই জল খাই ।
৪. রাতে বীন/বাশি বাজালে সাপ আসে : বীন বাজালে যে সাপ আছে- এই থিউরী আসলে মানুষ কোথা থেকে পেয়েছে কে জানে !! আমাদের বাংলা সিনেমাতে আমরা দেখেছি সাপুড়ে বীন বাজিয়ে নাগিনকে নাচিয়েছে । এমন কী আমাদের এলাকাতে যদি সাপ খেলা দেখাতে আসতো কোন সাপুড়ে সেখানেও দেখেছি বীন বাজিয়ে সাপের খেলা দেখাতে । পরে জেনেছি যে এই বীনের সাথে সাপের আসা না আসার কোন সম্পর্কে নেই ।
৫. এক শালিক দেখা: যখনই আমরা কোন শালিক পাখি দেখতাম তখনই তার সঙ্গী শালিক খুজতাম । যদি না খুজে পেতাম তাহলে সেটা দেখে প্রণাম করতাম।আমাদের এলাকাতে কুসংস্কার ছিল যে একা শালিক দেখলে যদি প্রণাম না করা হয় তাহলে বউ / স্বামী মরে যাবে অথবা দিন খারাপ যায়। আর দুই শালিক দেখলে আমরা অনেকেই বলতাম , “দুই শালিক নমস্কার পা দুটো পরিষ্কার ,মাথার চুল কালো দিনটি আমার ভালো।” এতে নাকি দিনটি খুব ভালো যাবে!!
আরও পড়ুন – নাবালিকাকে শ্লীলতাহানির অভিযোগে জেলে সিভিক ভলেন্টিয়ার
৬. দাঁত ইদুরের গর্তে ফেলা: দাঁত পড়ার অভিজ্ঞতা তো আমাদের সবারই আছে । আমারা সবাই দাঁতই বলতে গেলে ইদুরের গর্তে ফেলেছি । আমাদের গ্রামে প্রচলন ছিল যে যদি দাঁত ইদুরের গর্তে না ফেলা হয় তাহলে ভাল দাঁত উঠবে না ।
৭. পরীক্ষার দিন সকালে ডিম খাওয়া যাবে না: সকালের খাবার হিসাবে ছোট বেলা থেকে ডিম একটা কমন খাবার ছিল । সকালে বেলার খাবার ছিল, গরম ভাত, আলু সিদ্ধ /ডাল চচ্চরী আর সাথে ডিম ভাজি ইত্যাদি । কিন্তু পরীক্ষার সকালে আমরা কোন দিন ডিম খেতে পারি নি । এটা আমার মা খুব ভাল করে খেয়াল রাখতেন । এমন কি এখনও এটা অনেকেই মেনে চলেন। পরীক্ষার সময় সকালে বাড়িতে ডিম দেওয়া হয় না ।
৮. রাত নখ কাটা যাবে না : এই নিয়ম এখনও চলে । বিশেষ করে গ্রাম এলাকায় রাতের বেলা নখ কাটার উদ্যোগ নিলেই বাড়ির বড়দের কাছ থেকে কথা শুনতে হয় যে রাতে নখ কাটতে হবে না ।
৯. সন্ধ্যা বেলায় মেয়েদের চুল খোলা রাখলে ভুতে ধরে : এটা অবশ্য ছেলেদের সঙ্গে হয়না তবে আমাদের চোখের সামনে অনেক উদাহরণ হয়েছে। এবং এখনও হয় । সন্ধ্যা কিংবা দুপুর বেলা যদি চুল খোলা রেখে কোন মেয়ে বাইরে যায় তাহলে তাকে শুনতে হয় যে জ্বীন ভুতে ধরবে !
১০. কালো বেড়াল : এটা তো সব থেকে বেশি প্রচলিত কুসংস্কার । আমারা অনেকেই বেড়াল পছন্দ করি। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে খাবার পরে আমাদের সামনে বেড়াল থাকলে তাকেও খাবার / কাটা দিয়ে থাকি । তবে কালো বেড়াল এলে বাড়ির মানুষ জন সেটা ঠিক পছন্দ করে না । কালো বেড়াল মানেই অশুভ । অথচ একটা কালো বেড়াল সাদা বেড়াল আলাদা কোন ব্যাপার না ! এই সহজ স্বাভাবিক কথাটা মানুষ বোঝে না ।
১১. পেছন থেকে ডাকা : ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি যে বাবা /জেঠা/ কাকা / যখন অফিস / কাজে যাওয়ার জন্য বের হত তখন পেছন থেকে ডাক দিলে খুব রেগে যেত । পেছন থেকে ডাক দেওয়া মানে হচ্ছে অশুভ কিছু ঘটা !
১২.হেঁচকি উঠলে কেউ তোমাকে মনে করছে: এটা আপনারা শুনে থাকবেন । খাওয়ার সময় যখনই হেঁচকি উঠে এর মানে হচ্ছে তোমার কথা কেউ মনে করছে । আবার বন্ধুদের আড্ডায় কেউ
হেঁচকি তুললে অন্যরা বলতো , কিরে কে মনে করছে??
১৩. সাঁতার শিখতে হলে পিপড়া খাও : একদম ছোট বেলার কথা । সাঁতার শিখতে হলে নাকি পিপড়া খেতে হবে । পিপড়া যেমন মরে গেলে জলে ভাসে তাই জলে ভাসতে হলে এই পিপড়া খেতে হবে । অবশ্য আমি কোন দিন এই পিপড়া খাই নি । না খেয়েই সাঁতার শিখে গেছি ।
১৪. স্বামীর নাম মুখে আনা যাবে না : এটা তো এখনও আমাদের সমাজে খুব ভাল ভাবে প্রচলিত । মেয়েরা কখনই তার স্বামীর নাম সহসায় মুখে আনে না । তাদের বিশ্বাস যে স্বামীর নাম মুখে আনলে তার অমঙ্গল হবে । উল্লেখ্য, প্রথম সন্তান হবার পরে সেই সন্তানের বাবা বলেই বেশির ভাগ মেয়েরা স্বামীকে সম্বোধন করে থাকেন ।
১৫. বই খোলা রাখলে শয়তান পড়ে ফেলে: এটা খুব মজার একটা ব্যাপার । আমরা যখনই ছোট বেলায় পড়তে বসতাম, যদি এমন কোন দরকারে বাইরে যাওয়া লাগতো কিংবা অন্য রুমে যেতে হত, যদি বইটা খোলা রাখা অবস্থায় যেতাম তখন মা বলতো যে বই খোলা রেখে গেলে সেই পাতার পড়া শয়তানে পড়ে ফেলে । পরে সেই পড়া আর মুখস্ত হয় না ।
আরও আছে যেমন ভাঙ্গা আয়নাতে মুখ দেখা যাবে না, ভাঙ্গা চিরুনী দিয়ে চুল আচড়ানো যাবে না ইত্যাদি । এছাড়াও আরও অনেক কুসংস্কার রয়েছে আমাদের গ্রাম বাংলাতে ।
তবে এটা অস্বীকার করা যাবে না যে কুসংস্কারও আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।।এভাবেই আমরা অনেকই বড়ো হয়েছি ।আর সব কুসংস্কার যে আসলে খারাপ বা পুরোটাই বুজরুকি এমনটা নয় বরং অনেক কিছুর পিছনে যথেষ্ট কারণ আছে । আমাদের সবকিছুর ভালোমন্দ বিচার করেই চলা উচিত।।