জলপাইগুড়ি – এক মুহূর্তেই বদলে গিয়েছে ময়নাগুড়ির চেহারা। জলঢাকা নদীর ভয়ঙ্কর জলোচ্ছ্বাসে কার্যত নিশ্চিহ্ন ময়নাগুড়ি ব্লকের আমগুড়ি গ্রামপঞ্চায়েতের খাটোর বাড়ি, তারার বাড়ি ও চারের বাড়ি গ্রাম। তিন শতাধিক বাড়ি সম্পূর্ণ ভেসে গিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত অন্তত এক হাজার। ইতিউতি কয়েকটি ভগ্নপ্রায় ঘর ছাড়া গ্রামে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। গ্রামে ঢোকার পথও একাধিক জায়গায় ভেঙে গেছে, নদীর বাঁধে তৈরি হয়েছে বিশাল গর্ত, যেখানে এখন জল থইথই করছে।
বাড়ি-ঘর হারিয়ে অসংখ্য গ্রামবাসী আশ্রয় নিয়েছেন প্রশাসনের ত্রাণ শিবিরে। কেউ কেউ আবার রেললাইনের ধারে উঁচু জমিতে ত্রিপল টাঙিয়ে তৈরি করেছেন অস্থায়ী আশ্রয়। এখন তাঁদের একমাত্র ভরসা প্রশাসনের সাহায্য ও অজানা ভবিষ্যৎ।
খাটোর বাড়ি ও তারার বাড়ি গ্রামের পাশ দিয়েই চলে গিয়েছে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে গুয়াহাটি পর্যন্ত রেলের মূল লাইন। এখানকার মানুষদের মূল জীবিকা কৃষিকাজ। রবিবার সকালেও সব কিছু ছিল স্বাভাবিক। তখন জলঢাকা নদীতে জল কিছুটা বেশি হলেও বিপদের সম্ভাবনা কেউ বুঝতে পারেননি। কিন্তু আচমকা ভুটান থেকে হাতি নালার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ জল নেমে আসে জলঢাকায়।
মাত্র কুড়ি মিনিটের ব্যবধানে নদীর জল ভয়াবহভাবে বেড়ে যায়। প্রথমে বাঁধ উপচে জল ঢোকে গ্রামে, এরপর বাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙে যায়। মুহূর্তের মধ্যে প্রবল বেগে জল ছুটে আসে গ্রামে, ঘরবাড়ি একে একে ভেঙে পড়ে, বাড়ির টিনের ছাদ বেয়ে বইতে থাকে জল। শুরু হয় প্রকৃতির ভয়ঙ্কর ধ্বংসলীলা।
রাস্তাঘাট, গবাদিপশু, গাছপালা— কিছুই রক্ষা পায়নি। কংক্রিটের বাড়িগুলিও টিকতে পারেনি জলের তাণ্ডবে। গ্রামে প্রবেশের সব রাস্তা কার্যত নিশ্চিহ্ন। দু’জায়গায় বাঁধে তৈরি হয়েছে অন্তত পনেরো ফুট গভীর ও ত্রিশ ফুট চওড়া গর্ত। জলপাইগুড়ি জেলার এই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ এখন ভাসছে দুর্দশার স্রোতে।
চিঁড়ে তৈরির এক মিলও জলমগ্ন হয়ে পড়েছে— যা এখন একেবারে পুকুরে পরিণত হয়েছে। মিলের মালিক বিমল রায় বলেন, “আমার মিল আর ঘরবাড়ি সব ভেসে গেছে। পরিবার নিয়ে রেললাইনের ধারে ত্রিপলের নিচে আশ্রয় নিয়েছি। সরকার যদি সাহায্য করে, বাঁধটা যদি মেরামত হয়, তাহলে আবার নতুন করে শুরু করব।”
ত্রাণশিবিরে গিয়ে দেখা গেছে, অনেকেই দিন কাটাচ্ছেন অস্থায়ী ছাউনির তলায়। তাঁদের অভিযোগ, এখনও সরকারি সাহায্য মেলেনি, রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের দেওয়া ত্রাণের উপরই এখন নির্ভর করতে হচ্ছে।
ময়নাগুড়ির বিডিও প্রসেনজিৎ কুন্ডু জানিয়েছেন, “বন্যা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উদ্ধারকাজ শুরু হয়েছিল। দুর্গতদের ত্রাণশিবিরে এনে খাবার, ত্রিপল ও প্রাথমিক সাহায্য দেওয়া হয়েছে। গবাদিপশু মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে সরানো হচ্ছে। রোগের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে প্রশাসন সক্রিয় রয়েছে।”
অন্যদিকে, জলপাইগুড়ি জেলার যুব তৃণমূল সভাপতি রামমোহন রায় স্বীকার করেছেন, “পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ। মানুষের আতঙ্ক ও ক্ষোভ স্বাভাবিক। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশাসনকে তৎপর হতে বলেছেন। সবাই মিলে পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা চলছে।”
