ইউক্রেন থেকে নিজ দেশে ফিরলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের ৪ পড়ুয়া। যুদ্ধবিধস্ত ইউক্রেন থেকে নিজের দেশ তথা ভারতে ফিরলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের চারজন ডাক্তারি পড়ুয়া । তারা হলেন দাঁতনের অনন্যা পাইক , খড়্গপুরের প্রবীণ কুমার , বালিচক এর শিনজনি বেরা ও শীর্ষেন্দু সাউ । এদিকে গত এক সপ্তাহ ধরে ইউক্রেনে আটকে থাকা সবং এর সুশোভন বেরা শনিবার দিল্লি বিমানবন্দরে এসে পৌঁছেছেন ।
এ যেন মৃত্যুভূমি থেকে মাতৃভূমি-তে ফিরে আসা। মৃত্যু উপত্যকা ইউক্রেনের রাজধানী কিভ থেকে পায়ে হেঁটে হাঙ্গেরি স্টেশন (বুদাপেস্ট স্টেশন)। এরপর, হাঙ্গেরি থেকে দিল্লি। দিল্লিতে একদিন কাটিয়ে কলকাতা। কলকাতা থেকে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাঁতন ২ নম্বর ব্লকের গড়হরিপুরে নিজের বাড়িতে শনিবার সকালে এসে পৌঁছান অনন্যা পাইক। কিভ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী অন্যান্য’র চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ থাকলেও সুস্থ শরীরে বেঁচে ফেরার আনন্দে মুখে রয়েছে হাসি । অনন্যা জানান , ২৬ ফেব্রুয়ারি তাঁদের হস্টেলের একেবারে কাছেই সেল পড়েছিল । ২৮ ফেব্রুয়ারি সকালেই তাঁরা বেরিয়ে যান ।
অন্যান্য বলে চলেন , সঙ্গে খাওয়ার বলতে সামান্য চকলেট আর বিস্কুট। আর অল্প জল। ২১ তারিখ থেকে তাঁরা ভারী খাবার পাননি । শরীরে বল নেই, ভয়ে পা কাঁপছে । শুধুমাত্র মানসিক শক্তি আর জেদকে সঙ্গী করে পায়ে হেঁটে, সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুঝঞ্ঝা উপেক্ষা করতে করতে হাঙ্গেরি ।
বুদাপেস্ট থেকে ট্রেনে করে এয়ারপোর্টে।সেখান থেকে ভারত সরকারের বিমানে চেপে দিল্লি। এরপর, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির উদ্যোগে দিল্লি থেকে ধাপে ধাপে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে রাজ্য সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন।
অনন্যা’র বাবা অশোক কুমার পাইক জানান , প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির পাশাপাশি তিনি কৃতজ্ঞ বিজ্ঞানী ড. চিরন্তন চ্যাটার্জি এবং ড. সুকান্ত দাশগুপ্তর প্রতি ।
ড. চট্টোপাধ্যায়-ই তাঁর মেয়েকে সম্পূর্ণভাবে গাইড করে কিভ থেকে হাঙ্গেরি অবধি পৌঁছে যাওয়ার পথ নির্দেশ করে দিয়েছেন ইন্টারনেটের মাধ্যমে। উনি একসময় উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। এখন, রাঁচি-তে একটি সংস্থায় বিজ্ঞানী হিসেবে নিযুক্ত। ওনাদের দু’জন আর আর দুই সরকারের জন্যই যেন আমার মেয়ে নতুন জীবন ফিরে পেলেন । অনন্যা’র মা অপর্ণা শিকদার পাইক জানান , গত ১০-১২ দিন তাঁদের যে কিভাবে কেটেছে তা শুধু ঈশ্বরই জানেন। অনেক ধন্যবাদ জানাই মুখ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীকে। ওনাদের কাছে একজন মা হিসেবে শুধু এটুকুই চাইব, সমস্ত সন্তানদের ফিরিয়ে আনুন। কেউ যেন ওখানে আটকে না থাকে ।
খড়্গপুরের ১৫ নং ওয়ার্ডের প্রবীণ কুমারও শনিবার ফিরে এলেন নিজের বাড়িতে । তাঁর চোখেমুখে যেন যুদ্ধ জয়ের হাসি। পেলেন, বীরের সম্মান। শুক্রবার রাতে বাড়ি ফিরে আসা বছর ২১ এর প্রবীণ জানান , যেন নতুন জীবন ফিরে পেলেন । ২৪ ফেব্রুয়ারিই তাঁর ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু, ততক্ষণে রাজধানী কিভে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায়, বিমান বাতিল হয়ে যায়। তিনি থাকতেন ভিনিৎসিয়া-তে। ভিনিৎসিয়া ন্যাশনাল মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র । কিভ এবং খারকিভের মতো এই এলাকায় লাগাতার বোমাবর্ষণ না হলেও, ওখানেও ক্রমেই যুদ্ধের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছিল।
আর ও পড়ুন মালদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকের রক্ত সংকট মিটছে না
কারফিউ জারি করা হয়েছিল। বাংকারে আশ্রয় নিয়েছিলেন ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে। দিনে মাত্র ২ ঘন্টা সাইরেন বাজিয়ে খাবার আনতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হত। তারমধ্যেই, যেটুকু খাবার ও জল সংগ্রহ করে ফিরতেন। বাংকারের মধ্যে চারদিন মৃত্যুভয় আঁকড়ে বেঁচে ছিলেন ।
২৮ ফেব্রুয়ারি কোনোমতে সীমান্ত পেরিয়ে হাঙ্গেরি পৌঁছন। এরপর, ভারত সরকারের উদ্যোগে হাঙ্গেরি থেকে দিল্লি পৌঁছন ৩ মার্চ রাতে। সেখান থেকে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে শুক্রবার রাতে বাড়ি পৌঁছন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী’ কে ধন্যবাদ জানান ।
এদিকে গত এক সপ্তাহ ধরে ডাক্তারি পড়ুয়া সবং এর সুশোভন বেরা আটকে ছিলেন কিভের কাছে একাডেমিয়া টুপলোভা স্ট্রিট এর আবাসনের ব্যংকারে । সবং এর বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী মানস ভুইঁয়া বিষয়টি জানার পর থেকেই তাঁর পরিবারের পাশে দাঁড়ান । আশ্বাস দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির উদ্যোগে এরাজ্যের আটকে থাকা সব পড়ুয়া ইউক্রেন থেকে ভালোভাবে বাড়িতে ফিরতে পারবেন । এদিন দিল্লি বিমান বন্দরে পৌঁছেছেন সুশোভন । খুশির খবর বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী ডাক্তার মানস ভূঁইয়া।