ফুটবল বিশ্বকাপের বিভিন্ন আশ্চর্য জনক ঘটনা। ফুটবল বিশ্বকাপ—চার বছর পরপর এই একটি ইভেন্ট মানুষকে খেলায় মাতিয়ে রাখে। বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় এই খেলা নিয়ে গল্প এবং মিথের অভাব নেই। ১৯৩০ সাল ধরে শুরু হওয়া বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সঙ্গে মিলেমিশে আছে নানা ইতিহাস। আছে বিচিত্র সব ঘটনাও। এনটিভি অনলাইনের ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের আজকের পর্বে থাকছে বিশ্বকাপ রঙ্গমঞ্চের সেসব বিচিত্র কিছু ঘটনাপ্রবাহ।
কুকুরের ট্রফি উদ্ধার
বিশ্বকাপের মূল আকর্ষণ ট্রফি। যে ট্রফি জয়ের জন্য লড়াই করে দলগুলো, সেই ট্রফিই যদি লাপাত্তা হয়ে যায় তাহলে কেমন হয়? হ্যাঁ, ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপে সেটাই হয়েছিল। ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপ শুরুর আগে চুরি হয়ে যায় জুলে রিমে ট্রফি। এমন ঘটনায় বিশ্বকাপ শুরু হওয়া নিয়েই শঙ্কা জাগে। দ্রুত তৈরি করা রেপ্লিকা ট্রফি। পরিস্থিতি যখন এই তখন নায়ক বনে যায় একটি কুকুর।
আয়োজক ইংল্যান্ডের মান বাঁচায় এক পোষা কুকুর, যার নাম পিকলস। লন্ডনের ডাস্টবিনের একটি ঝোপের নিচ থেকে ট্রফিটি খুঁজে পায় পিকলস। ট্রফি উদ্ধার করে ইংল্যান্ডের রানির মান বাঁচায় পিকলস। সেই বিশ্বকাপ অবশ্য ইংল্যান্ডের হাতেই ওঠে। তবে চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের চেয়ে বড় তারকা বনে যায় কুকুর পিকলস।
অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বিড়ম্বনা
১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপের ঘটনা। এক অদ্ভুত কারণে ওই বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ শুরু হতে বিলম্ব হয়েছিল। কারণটা ছিল অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড। ইংল্যান্ডের সাতজন খেলোয়াড় হোটেলে তাঁদের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড রেখে যান। ইংল্যান্ডের জাতীয় খেলোয়াড়দের চেহারা পুলিশ চিনলেও তাঁদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কারণ নিয়মকানুন সবার উপরে! পরে হোটেল থেকে অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড আনানোর পর খেলোয়াড়রা মাঠে প্রবেশ করেন এবং খেলা শুরু হয়।
১৯৭৮-এ আর্জেন্টিনার প্রশ্নবিদ্ধ বিশ্বকাপ জয়
নিজেদের মাঠে ১৯৭৮ সালে প্রথমবার বিশ্বকাপ জয়ের গৌরব অর্জন করে আর্জেন্টিনা। কিন্তু ওই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার চ্যাম্পিয়ন হওয়া নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। বিশ্বকাপটি হয় রবিন লিগ পদ্ধতিতে। দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠতে হলে পেরুকে ৪ গোলে হারাতেই হতো আর্জেন্টিনার। গ্রুপ পর্বের আগের ৪ ম্যাচে ছয় গোল করা আর্জেন্টিনা বাঁচামরার ম্যাচটিতে পেরুকে হারায় ৬-০ ব্যবধানে। চেজার লুইস মেনত্তির দলের ওই জয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে ফুটবল মহলে।
ব্রিটিশ মিডিয়া দাবি করে, সে ম্যাচটি নাকি পাতানো ছিল। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পেরুকে ম্যাচটি পাতাতে বাধ্য করেছিল আর্জেন্টিনা। ওই সময় পেরুতে এককভাবে গম সরবরাহ করত আর্জেন্টিনা। এ ছাড়া বেশকিছু লাতিন মিডিয়ারও দাবি ছিল, ওই ম্যাচটি নিয়ে দু-দেশের মধ্যে বন্দিবিনিময় চুক্তি হয়েছিল। সেই ম্যাচের পর নাকি পেরুর ১৩ জন নাগরিক আর্জেন্টিনার জেল থেকে ছাড়া পান। এসব কারণে আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপ চূড়ান্ত প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
বিশ্বকাপে ইউরোপের অনিহা
ইউরোপকে ছাড়া ফুটবলকে কল্পনাই করা যায় না। কিন্তু ইউরোপেরই নাকি ফুটবল বিশ্বকাপে অনিহা জাগে। হ্যাঁ, বিষয়টি সত্যি। ১৯৩০ সালে উরুগুয়েতে হওয়া প্রথম বিশ্বকাপে কোনো বাছাইপর্ব ছিল না। ফিফা প্রায় সব দেশকেই সেই আসরে খেলার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক দুরাবস্থা ও আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে লাতিন দেশ উরুগুয়েতে যাওয়ার আগ্রহ দেখায়নি পুরো ইউরোপ। পরে ফিফা সভাপতি জুলেরিমের কল্যানে নাম দেওয়ার শেষ দিনে বিশ্বকাপে যোগ দেয় ফ্রান্স, বেলজিয়াম, যুগোশ্লাভিয়া ও রোমানিয়া।
পরীক্ষার কারণে বিশ্বকাপ ছাড়া
ফুটবল বিশ্বকাপ একজন ফুটবলারের জন্য স্বপ্নের বিষয়। অথচ শুরুর দিকে এই টুর্নামেন্টকে সেভাবে গুরুত্ব দিতেন না ফুটবলাররা। এই যেমন প্রথম বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার অধিনায়ক ম্যানুয়েল ফেইরা বিশ্বকাপ ছেড়ে গিয়েছিলেন পরীক্ষার জন্য। প্রথম বিশ্বকাপ চলাকালীন আর্জেন্টিনা দলের অধিনায়ক ম্যানুয়েল ফেইরা আইনের ছাত্র ছিলেন। গ্রুপপর্বের দুটি ম্যাচ খেলার পর পরীক্ষার জন্য নিজ দেশে ফিরে যান তিনি।
ভারতের জুতা বিহীন খেলতে চাওয়া
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৪২ ও ১৯৪৬ সালে বিশ্বকাপ মাঠে গড়ায়নি। ১৯৫০ সালে বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার জন্য দলই খুঁজে পাচ্ছিল না ফিফা। তখন সুযোগ মেলে ভারতের। কিন্তু সেই সুযোগ লুফে নিতে পারেনি ভারত। কথা রটে, ভারত নাকি জুতা ছাড়া খেলতে চেয়েছিল। কিন্তু তাতে সায় দেয়নি ফিফা। পরে আর খেলা হয়নি ভারতের। আবার এও শোনা যায়, অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন (এআইএফএ) নাকি বিশ্বকাপ থেকে অলিম্পিককেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল।
লাল-হলুদ কার্ডের আগমন
১৯৭০ সালের বিশ্বকাপের সময় প্রথম লাল কার্ড এবং হলুদ কার্ডের ব্যবহার শুরু হয়। এর আগে রেফারিরা খেলোয়াড়দের মৌখিকভাবে বরখাস্ত করতেন। কিন্তু ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপে ঘটে বিপত্তি। কারণ ওই বিশ্বকাপে আর্জেন্টাইন এক খেলোয়াড়কে বরখাস্ত করা হলে তিনি না বোঝার ভান করেছিলেন। বিষয়টি নিয়ে বেধে যায় হট্টগোল। পরবর্তীতে পরের বিশ্বকাপেই লাল কার্ড ও হলুদ কার্ডের আগমন ঘটে।
৪ নম্বর জার্সির দ্বিধা
ফিফার নিয়ম অনুসারে, বিশ্বকাপের তালিকায় থাকা খেলোয়াড়দের জার্সি নম্বর ১ থেকে ২৩ পর্যন্ত হওয়া উচিত৷ বিষয়টি জাপানের জন্য বিশেষ সমস্যা তৈরি করে কারণ তারা ৪ নম্বর এড়াতে চেষ্টা করে। মূলত জাপানি ভাষায় চার শব্দটি মৃত্যুর মতো বুঝায়। ফলে তারা এটা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যেত। এর জন্য জাপানিরা ড্র করে সিদ্ধান্ত নিত যে কে পরবেন ৪ নম্বর জার্সি।
বল নিয়ে ঝগড়া
প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ে। ওই সময় অফিশিয়াল বলের প্রচলন ছিল না। ফাইনালে দুই দলই দুটি বল মাঠে নিয়ে এসেছিল। দুদলেরই প্রত্যাশা ছিল তাদের বল নিয়ে খেলা হবে। এটা নিয়ে রেষারেষি হয়। শেষ পর্যন্ত পরে রেফারি দুই দলের মন রাখেন। ম্যাচের দুই অর্ধে দুই দলের দুই বল ব্যবহার করেন।
আরও পড়ুন – কয়লা পাচার ও বেআইনিভাবে মজুতের অভিযোগে বীরভূমে গ্রেফতার ৬
মারাকানা ট্র্যাজেডি
১৯৫০ বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল ব্রাজিল ও উরুগুয়ে। ম্যাচটি ড্র করলেই শিরোপা নিশ্চিত হতো ব্রাজিলের। তাই বিশ্বকাপ জয় নিয়ে শতভাগ আশাবাদী ছিল ব্রাজিল। এমন কি মূল লড়াই শুরুর আগে ব্রাজিলীয় দৈনিক ‘ও মুন্দো’ ব্রাজিল দলের একটা ছবি ছাপিয়ে লিখেছিল, ‘এরাই হলো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন!’ পত্রিকাটির অনেকগুলো সংখ্যা কিনে উরুগুয়ে অধিনায়ক ওবদুলিও ভ্যারেলা নিজেদের হোটেল রুমের টয়লেটে নিয়ে ফেলেছিলেন। সতীর্থদের বলেছিলেন পত্রিকাগুলোর ওপর প্রস্রাব করতে! দলের আত্মবিশ্বাস বাড়াতেই এটা করেছিলেন অধিনায়ক। শেষ পর্যন্ত তাঁর আত্মবিশ্বাসই জিতল। ফাইনালে লাখো দর্শকের সামনে স্বাগতিক ব্রাজিলকে ২-১ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতে নেয় উরুগুয়ে। ব্রাজিলিয়ান ভক্তরা এ ঘটনায় অনেক বড় ধাক্কা খায়। এমনকি এতটাই ভেঙে পড়ে যে, ফাইনালের পর মারাকানা স্টেডিয়ামের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে দর্শকদের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। যেটা পর্তুগিজ ভাষায় ‘মারাকানাজো’ নামে কুখ্যাত।
জিনেদিন জিদানের ঢুস কাণ্ড
২০০৬ বিশ্বকাপের ফাইনাল। মুখোমুখি ইতালি ও ফ্রান্স। ম্যাচটির অতিরিক্ত সময়ে এক বিতর্কের জন্ম দেন ফরাসি তারকা জিনেদিন জিদান। ১০৪তম মিনিটে মেজাজ ধরে না রাখতে পেরে হঠাৎ করে ইতালিয়ান ডিফেন্ডার মাতেরাজ্জিকে ঢুস মেরে বসেন জিদান। সঙ্গে সঙ্গে লাল কার্ড দেখানো হয় তাঁকে। হাতছোঁয়া দূরত্বে বিশ্বকাপ রেখে ফেরত আসেন জিদান। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের শেষটা হয় বিতর্ক দিয়ে। জিদান মাঠ ছাড়লে ফ্রান্সও তাদের পথ হারায়। শুরুতে লিড পাওয়া ফ্রান্স শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে গিয়ে ইতালির কাছে ৫-৩ গোলে হেরে যায়। বিশ্বকাপের ইতিহাসের বিতর্কিত ঘটনাটির মধ্যে একটি হয়ে আছে জিদানের এই ঢুস মারার ঘটনাটি।