দক্ষিন 24 পরগণা – ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী গ্রামগুলিতে নারী ও শিশু পাচার ক্রমশ আরও সক্রিয় হয়ে উঠছে, অথচ প্রশাসনের তেমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না। বসিরহাটের বিস্তীর্ণ এলাকা একদিকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত আর অন্যদিকে সুন্দরবনের জঙ্গলে ঘেরা। এই জল, জঙ্গল এবং কাঁটাতারহীন এলাকা পাচারকারীদের কাছে আদর্শ পথ হয়ে উঠেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, পাচারকারীরা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অবাধে নারী ও শিশু পাচার চালিয়ে যাচ্ছে।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে এক নাবালিকার জীবনে নেমে আসে অকল্পনীয় অন্ধকার। পাচারকারীরা প্রথমে তার মাসিকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে বশ করে এবং বসিরহাট শহর দেখানোর নাম করে তাকে বাড়ি থেকে বের করে আনে। বসিরহাট শহরের প্রবেশদ্বার ইছামতি ব্রিজে পৌঁছানোর পর মাসি ও পাচারকারীরা মিলে পাকাকলা ও পাউরুটির সঙ্গে মাদক মিশিয়ে খাইয়ে অচেতন করে দেয়। জ্ঞান ফেরার পর নাবালিকা নিজেকে মুম্বাইয়ের এক নিষিদ্ধ পল্লীতে আবিষ্কার করে, যেখানে তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে বছরের পর বছর ধরে তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। পরিবারের কাছে ফিরে আসার আর্তনাদ বারবার উপেক্ষিত হয়।
কয়েক বছর পর ভাগ্যের জোরে একদিন সে নিজের বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসতে সক্ষম হয়। পরিবার তার বিয়ের ব্যবস্থা করে, কিন্তু বিয়ের পর সে জানতে পারে তার স্বামীই আসলে সেই পাচারকারী, যিনি তাকে বিক্রি করেছিলেন। তাহলে কি নিজের স্ত্রীকে বিক্রি করার পর তাকেই আবার বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়েছে? নাকি এর পেছনে আরও বড় কোনো পাচারচক্র রয়েছে—এই প্রশ্ন আজও অমীমাংসিত।
এই ঘটনার পর বসিরহাট থানায় তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হলেও আজও কেউ সাজা পায়নি। বরং সীমান্তবর্তী গ্রামগুলি থেকে এখন পর্যন্ত আনুমানিক সাত-আট জন মেয়ে ভিনরাজ্যে বিক্রি হয়ে গিয়েছে বলে জানা গেছে। একাধিক নাবালিকা ধর্ষণের শিকার হয়েছে এবং অভিযুক্তরা এখনও বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাচার হয়ে ফিরে আসা ওই অসহায় নারী জানান, তিনি এখনও প্রাণনাশের হুমকি পাচ্ছেন। সমাজে কোনো সম্মান নেই, বৃদ্ধ বাবার সঙ্গে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারানোর উপক্রম হয়ে একরকম জীবন্ত লাশের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ক্যামেরার সামনে আসতে নারাজ, কারণ তার আশঙ্কা—পাচারকারীরা তাকে খুন করে ফেলতে পারে।
পাচার হওয়ার পর ফিরে আসা নাবালিকা গ্রামের এক যুবক, মাসি এবং স্বামীর বিরুদ্ধে স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল উপপ্রধানকে অভিযোগ জানালেও কোনো সাহায্য পাননি। বরং তাকে উল্টো হুমকি দেওয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে, পাচারকারীদের সঙ্গে ওই উপপ্রধানের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। পঞ্চায়েতের ক্ষমতার জোরে কি তিনি পাচারচক্রকে মদত দিচ্ছেন, নাকি এর পেছনে আরও বড় কোনো নারী পাচারচক্র সক্রিয় রয়েছে—এই প্রশ্ন এখন সর্বত্র ঘুরপাক খাচ্ছে।
আজও সেই নারী বিচারের আশায় বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তার একটাই আর্তি, যে নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে, তা যেন আর কোনো নারীর সঙ্গে না ঘটে।
