কিভাবে চাষ করবেন দেশি মাগুর? দেশি মাগুর সুস্বাদু ও পুষ্টিসমৃদ্ধ একটি প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ। আশার কথা আমাদের মাছ চাষিরা এই মাছটিকে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বিলুপ্তির হাত থেকে ফিরিয়ে এনেছে।
দেশি মাগুরপোনা উৎপাদন প্রযুক্তির একটি নিবিড় গবেষণা
দেশি মাগুর সুস্বাদু ও পুষ্টিসমৃদ্ধ একটি প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ। আশার কথা আমাদের মাছ চাষিরা এই মাছটিকে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বিলুপ্তির হাত থেকে ফিরিয়ে এনেছে। দেশি মাগুরের পোনা কীভাবে উৎপাদন করতে হয় তা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি-
পুকুর নির্বাচন:
দেশি মাগুরের পোনা উৎপাদনের জন্য সাধারণত ১৫/২০ শতাংশের আয়তাকার তলা শুকানো পুকুর হলে ভাল হয়। প্রজনন মৌসুমের আগে পুকুর শুকিয়ে যায় এমন পুকুর নির্বাচন করা দরকার। পুকুরের তলা ৮/১০ ইঞ্চি ঢালু হওয়া দরকার।
পুকুর তৈরি:
দেশি মাগুরের রেনু থেকে পোনা উৎপাদনের জন্য পুকুর তৈরি একটা বড় ভূমিকা পালন করে। পুকুর তৈরিতে কোনো ত্রুটি থাকলে কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাবে না। পুকুরের তলায় জল থাকলে প্রথমেই সেচ দিতে হবে। শতাংশ প্রতি ১ কেজি হারে চুন জলের সাথে মিশিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। এরপর মই দিয়ে রোদে শুকিয়ে পুকুরের চারপাশ পরিষ্কার করতে হবে। পুকুরের পাড়ে জাল দিয়ে ভালভাবে বেড়া দিতে হবে। মাটি থেকে এ জালের উচ্চতা হবে কমপক্ষে চার ফুটের মত।
আর ও পড়ুন মাছ চাষের আদর্শ পুকুরের বৈশিষ্ট্য
স্যালো মেশিন দিয়ে ১ ফুট থেকে ১.৫ ফুট পরিষ্কার জলে পুকুর ভরতে হবে। মনে রাখতে হবে, অপরিষ্কার জল কিছুতেই পুকুরে দেয়া যাবে না আবার বেশি জলও দেয়া যাবে না। অনেক খামারি ২/৩ ফুট জলের মধ্যেই রেনু ছাড়েন বলে দশ ভাগের একভাগ পোনাও উৎপাদন হয় না শুধুমাত্র জলের উচ্চতার কারণে। আমি পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি- দেশি মাগুরের রেনু থেকে পোনা উৎপাদনের জন্য নার্সারি পুকুরের জলের উচ্চতা ১ ফুট বা তার চেয়ে কম হলে ভাল উৎপাদন হয় আর বেশি হলে পোনা ১ থেকে ১.৫ ইঞ্চি সাইজ হওয়ার পর চিকন হয়ে মাথা জলে লম্বালম্বিভাবে খাড়া করে দিয়ে স্থির থেকে পরবর্তীতে ব্যাপকহারে মারা যায়। খামারিরা একে রোগ মনে করে বিভিন্ন এন্টিবায়োটিক ঔষুধ প্রয়োগ করে। কিন্তু এতে কাজের কাজ কিছুই হয় না।
দেশি মাগুর বাতাস থেকে অক্সিজেন নিয়ে বেঁচে থাকে। বারবার বেশি জলের উচ্চতায় অক্সিজেন নিতে গিয়ে মাছের কায়িক পরিশ্রম বেশি হয়, ফলে এক সময় খুব দুর্বল হয়ে খাবার ছেড়ে দিয়ে পরবর্তীতে মারা যায়। এ ঘটনা ঘটে রেনু ছাড়ার প্রথম এবং দ্বিতীয় সপ্তাহে; রেনুর সাইজ যখন এক ইঞ্চি বা তারচেয়ে একটু বড় হয়। অনেকে ভাবতে পারেন কম পানিতে দেশি মাগুর বাঁচানো যাবে কিনা? এর উত্তর হল, আমাদের দেশে মে-জুন-জুলাই মাসে মাগুরের পোনা উৎপাদনের সময় রোদের তাপমাত্রা এত বেশি থাকে যে পুকুরের তলা পর্যন্ত গরম হয়ে যায়। এ সময়ে দু’টি ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
১. পুকুরের এক পাশের জলের উচ্চতা আরেক পাশের চেয়ে ১ ফুটের বেশি থাকে। অর্থাৎ এ পাশের জলের উচ্চতা ১ ফুট হলে অন্যপাশের উচ্চতা হবে প্রায় ২ ফুট। এতে প্রচন্ড রোদের সময় দেশি মাগুরের রেনু গরম থেকে বাঁচার জন্য নিজে নিজেই পুকুরের গভীর অংশে চলে যাবে। আবার রাতে তাপমাত্রা কমার সাথে সাথে কম জলের উচ্চতায় চলে আসবে।
২. কচুরীপানা দিয়েও পুকুরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ ক্ষেত্রে পুকুরের ৪/৫টি জায়গায় কচুরীপানা দিয়ে ৫ ফুট ব্যাসের বৃত্তাকার শেড তৈরি করতে হবে।
খাবার প্রয়োগ পদ্ধতি: নার্সারি পুকুরে রেনু ছাড়ার পর খাদ্য হিসেবে ডিমের কুসুম ও আটা মিশিয়ে খাবার হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে ২০ শতাংশ পুকুরের জন্য ২০টি হাঁসের ডিম সিদ্ধ করার পর ব্লেন্ডার করে কাপড় দিয়ে ছেকে নিতে হবে। এরপর ফুটন্ত জল ওভেন থেকে নামিয়ে ওই পাত্রে ১ কেজি আটা মিশিয়ে ভাল করে নাড়াচাড়া দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন আটা পাত্রের তলায় লেগে বা জমে না যায়। আটা পাত্রর তলায় লেগে বা পুড়ে গেলে মাছের জন্য এটি খুবই ক্ষতিকর। আটা ভালভাবে মেশানোর পর টিওবওয়েলের পরিষ্কার জল মিশিয়ে ঠান্ডা করতে হবে। তারপর জলে মেশানো ডিমের কুসুমের সাথে আটা মেশানো জল এক করে গুলিয়ে মাছর খাবার হিসেবে পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।
সন্ধ্যার পর একবার, রাত ১২ টার সময় একবার এবং ভোরে একবার মোট ৩ বার পুকুরে খাবার প্রয়োগ করতে হবে। দিনের বেলা মাগুরের পোনা খেতে চায় না বলে খাবার না দেয়াই ভাল। এভাবে ৫/৬ দিন খাবার দেয়ার পর ৬দিন থেকে কৈ মাছের নার্সারি ফিড দেয়া যেতে পারে। ৩০ দিনের মধ্যেই প্রায় ৩ ইঞ্চি সাইজের পোনা হয়ে গেলে চাষের পুকুরে স্থানান্তরিত করতে হবে।