সমাজ টিভি সিরিয়াল চলচ্চিত্রের কু-প্রভাব আটকাতে কেন্দ্রীয় সরকার। বাংলা সিরিয়ালের কু-প্রভাব। এমনিতে কয়েক ঘন্টা চলে যায় টিভি স্ক্রিনের সামনে। গৃহস্থালির কাজ মাথায় ওঠে এই সময়। ধরে নিতে হয় টিভির প্রভাব কতটা প্রবল। কয়েকটি সিরিয়াল দেখুন- ঢাকি — যমুনাকে পূজোর বিসর্জনের দিন খুনের চেষ্টা হয়। তার স্বামীকে বিয়ে করতে চায় আর এক প্রেমিকা ও পরিবারের মেয়ে স্বামীর পিসি দুজনে মিলে এই খুনের চেষ্টা করে। সবাই জানে সে মারা গেছে। যদিও শেষ পর্যন্ত মারা যায়নি। বাঁচিয়ে তোলা হয়েছে। পিসি শ্বাশুড়ি কী এতটা নির্মম হতে পারেন !
কৃষ্ণকলি– মেজ ছেলে বাবাকে খুন করে সম্পত্তি হাতানোর তালে আছে। আগে ভাই ও ভাইবউকে খুনের চেষ্টা করে জেল খেটেছে। এখন শুধু মেজ ছেলে নয়, আবার এক নাতি ও তার বাগদত্তা বিদেশ থেকে এসে কোম্পানি ও বাড়ি গ্রাস করার চক্রান্ত করছে।
প্রয়োজনে ঠাকুরমাকে মেরে ফেলার চেষ্টায় আছে। তার আগে যমজ ভাইকে গুন্ডাদের হাতে আটকে রেখেছে সম্পূর্ণ সম্পত্তি হাতড়াবে বলে। একটি পরিবারের ব্যবসা বাণিজ্যে সমস্যা থাকে তাবলে একের পর এক খুন ও খুনের পরিকল্পনা ! অসম্ভব ও ভারসাম্যহীন চিন্তাভাবনা। তাহলে তো আম্বানি আদানিরা এত বিশাল সব পারিবারিক ব্যবসা বিস্তার করতে পারতেন না। এসব লেখকের অসুস্থ চিন্তাভাবনা।
খেলাঘর– বিচারক নিজে মেয়ের প্রেমিককে মারার জন্য ষড়যন্ত্র করছেন। ভাইদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বস্তি উচ্ছেদ করছেন। মারপিঠে মদত দিচ্ছেন। ঘৃণার প্রচার করছেন। বিচারপতির মর্যাদা হানিকর অনেক বিষয় টেনে আনা হয়েছে সিরিয়ালে যা অবাস্তব।
বরন– অপছন্দের মানুষকে বিয়ে করে, একঘরে কয়কমাস একসঙ্গে বসবাস করে, এক শয্যায় রাত্রিবাস করে, নায়ককে বাংলা সংষ্কৃতির পাঠ পড়িয়ে, আবার মায়ের পছন্দের অন্য ছেলের সঙ্গে বিয়েতে রাজী হয়েছেন নায়িকা ! প্রথম স্বামী যিনি জোর করে তাকে সিঁদুর পরিয়েছিলেন তিনিই দাড়িয়ে থেকে এই বিয়েটা দিচ্ছেন। ভাবুন তো; কি মহান কাজ ! গুল মারার একটা সীমাপরিসীমা থাকে। কিন্তু এই টিভি সিরিয়ালে সেসব নেই।
বিয়ে– সিরিয়ালে যতবার খুশী বিয়ের সিন দেখাতে হবে। বিয়ের সিন দেখলেই তরুণীরা দাঁড়িয়ে পড়বে। অথবা ওইপর্বটা দেখার জন্য সাময়িক ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ ঘোরাবেন টি ভি স্ক্রিনে। একবার দুবার যতবার বিয়ের সিন ততই মজা। ততই টি আর পি। বৈধ বা অবৈধ যেকোন বিয়েই দর্শক টানার হাতিয়ার ডিরেক্টরদের। একবউ, একবিয়ে, একবর, এসব এখন অচল। একের বদলে ‘বহু’র কালচার চারিত করা হচ্ছে।
পুলিশ বা আইনের ভুমিকা গৌণ– সিরিয়ালে খুন, খুনের চেষ্টা, প্রতারণা, মরদাঙ্গা, ডোমেষ্টিক ভায়োলেন্স ঘটছে অথচ এসবে আইন বা পুলিশের ভূমিকা প্রায় দেখানোই হয়না। দেখানো হলে অপরাধ প্রবণতা কমত। লেখক তাতে কোপ আগ্রহ দেখান না। অথচ এই লেখকদের বিভিন্ন কমিশনের মাথায় বসানো হয় !
হিন্দি সিনেমাই এইসব আইডিয়ার আধার। তারাই এইসবের নেতৃত্বে। হিন্দির লেখক, পরিচালক, প্রযোজকরাই এই ব্যবসার প্রবর্তক। সেখান থেকেই আইডিয়া, প্লট, ধারণা, অনুভব সব কপি করে, সেই একই কাহিনি একটু এদিক ওদিক করে অন্যভাষার সিরিয়ালেও দেখানো হচ্ছে। অন্যসব আঞ্চলিক ভাষার চিত্রনাট্যের কাহিনিকাররা সেখান থেকে কন্টেন্ট ধার করছেন আর রাজ্যের আঞ্চলিক ভাষার চ্যানেলে তা চালাচ্ছেন। তাই সব টিভিতে সন্ধ্যা থেকে ঘন্টার পর ঘন্টা দেখানো হচ্ছে। পরিবারের কাজকর্ম গৃহকর্ম চুলোয়।
এইধরনের ঘটনা প্রতিদিন প্রতিক্ষণে ঘরের বাচ্চারা, কিশোররা প্রত্যক্ষ করছে আর অপরিণত মনে তার ছাপ পড়ছে। নিজেদের জীবনে তার প্রয়োগ করার জন্য শিক্ষা পাচ্ছে। এটা ভীষন ক্ষতিকারক উপলদ্ধি।
অন্য প্রেমিকাকে খুন করার চেষ্টা কোন অর্থে সমাজের কাছে স্বাস্থ্যবান ! কোন সমাজে এমন ঘটনা ঘটে কী ! সাধারণত ঘটেনা। হাজারে লাখে একটি আধটি ঘটতে পারে। আর এমন একটি আধটি ঘটনাকে কী সার্বিক সামাজিক চেহারা বলে ধরা যায় ! যায় না।
১ নভেম্বর কেন্দ্রীয় টি ভি সিরিয়াল নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি সোনিকা খট্টর নির্দশ দিয়েছেন, বাংলা বা হিন্দি ধারাবাহিকে যে শাশুড়ি-বউমার ঝগড়া, কূটকাচালি দেখানো হয় তা আর দেখানো চলবেনা। এমনকি মেরে ফেলার ছক কষা পর্যন্ত দেখানো হয়। তা নিয়ে অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন মাধ্যমে আপত্তি তোলা হচ্ছিল। সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্টরাও অনেক বার এ বিষয়ে মুখ খুলেছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন, বলেছেন এই ধরণের বিষয় দেখানো বন্ধ হওয়া উচিত। নয়তো এগুলো সামজের বহু মানুষকে খারাপ ভাবনায় প্রভাবিত করছে। তা সত্বেও চলছে। কী করে চলছে প্রশ্ন সেখানে।
টলিপাড়ায় এ খবর আসতেই মোটামোটি চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন বাংলার খল নায়ক বা নায়িকারা। বাংলা ধারাবাহিকে খলনায়িকাদের রমরমা বেশি। খলনায়িকা হিসেবে তুমুল জনপ্রিয় মৌমিতা গুপ্ত। স্বাগতা মুখোপাধ্যায়, জুন আন্টি ওরফে ঊষসী চক্রবর্তীর মতো অভিনেত্রীরা। এরা না থাকলে মানুষ সিরিয়াল দেখবে বলে মনে হয় না অনেকেরই।আবার অম্বরীশ ভট্টচার্যর মতো অভিনেতারা কিন্তু চান যে , শুধু ভাল দিক দেখানো হলে সত্যিই তা আনন্দের।
অভিনেতার সঙ্গে সহমত টলি পাড়ার অনেকেই। কিন্তু প্রশ্ন হল কবে থেকে এই নিয়ম চালু হবে? যদি হয়, তবে কি হবে বর্তমানের সিরিয়াল গুলোর। সর্বজয়া থেকে শুরু করে শ্রীময়ী, সব জায়গাতেই রয়েছেন খল নায়িকারা। তাঁদের বাদ দিয়ে কিভাবে চলবে সিরিয়াল? নাকি রাতারাতি বদলে ফেলা হবে চরিত্রের শেড ! তারমানে অদূর ভবিষ্যতে হতেই পারে শ্রীময়ী আর জুন আন্টি প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠেছেন।
কিংবা সর্বজয়ার প্রাণের সই হয়ে উঠেছেন বড় জা মৌমিতা গুপ্ত। হতেই পারে এমনটা! তবে সে সব সামলাতে হিমশিম খেতে হবে অভিনেত্রী থেকে পরিচালক সকলকেই। দেখা যাক এই নোটিশের প্রভাব কতটা কার্যকরী হয় বা সরকারের পক্ষথেকে কতটা নজরদারি করে সুরাহা বা সুধার আনা হয়। শেষমেশ কতদূর পরিবর্তন আসে তা দেখার।
বাংলাসহ আঞ্চলিক ও জাতীয় হিন্দি ভাষার টিভি সিরিয়াল নিয়ে এবার ভাবিত জাতীয় নিয়ন্ত্রকরা। এবার নামল কঠোর নজরদারি। সরকার কিছুটা নড়েচড়ে বসছে সমাজ টিভি সিরিয়াল চলচ্চিত্রের কু-প্রভাব আটকাতে। আইন করে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা আগেও হয়েছে কিন্তু কোন সুরাহা মেলেনি। এবার দেখা যাক কতটা সফলতা আসে। এই আলোচনার আগে কয়েকটি বাংলা সিরিয়ালের কিছু ঘটনা উল্লেখ করা যাক।
আরও পড়ুন – “বাংলা ভারতকে পথ দেখাবে”- রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস
আরো একটা বিষয় খুব অবাস্তব দেখা যাচ্ছে। পছন্দের প্রেমিকাকে বিয়ে না করে নায়ক অন্য একজনকে বিয়ে করছেন। এবার অপছন্দের বউকে আপনি করে কথা বলছেন। একঘরে রাতে স্বামী স্ত্রী হিসাবে থাকছে। দিনের দিন এক শয্যায় কাটানোর পরেও তাদের মধ্যে কোন শারীরিক সম্পর্ক হচ্ছেনা। বাস্তবে এসব কী করে সম্ভব ! এতটা অবাস্তব দেখানো সম্ভব হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে লেখকের মানসিকতা নিয়ে। কেন একটি সামাজিক কাহিনিতে এমন অবাস্তব দৃশ্য দেখানো হচ্ছে।
এবার এসব নিষ্ঠুরতা, গার্হস্থ্য হিংসার ছবি বন্ধ করতে সচেষ্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে সাধুবাদ জানিয়ে অপেক্ষায় থাকুন ফললাভ হয় কি না।
‘How do we merge entertainment and education? We live in a world where entertainment wins, but if entertainment can have an educational heart, then we can really change people’s lives.’ by Jay shetty, a famous English Author.
সমাজ টিভি সিরিয়াল চলচ্চিত্রের কু-প্রভাব আটকাতে কেন্দ্রীয় সরকার ।