প্রয়াত সুরজিত সেনগুপ্ত, খেলার দুনিয়ায় শোকের ছায়া । করোনার কাছে আত্মসমর্পণ আরও একজন ফুটবলার।পায়ের জাদুতে একসময় মুগ্ধ করেছিলেন। কেড়ে নিয়েছিলেন সাতের দশকের ফুটবলপ্রেমীদের মন। আজ যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করে অমৃতলোকে পাড়ি দিলেন। শিল্পী ফুটবলার হিসেবেই ভারতীয় ফুটবলে পরিচিত ছিলেন সুরজিৎ সেনগুপ্ত।
তাঁর ড্রিবলিং, ডান প্রান্ত দিয়ে বল নিয়ে ছোটা সবই ছিল দর্শকদের চোখের আরাম। হুগলি জেলার চকবাজারের ছেলে সুরজিৎ নজরে পড়ে যান ফুটবলার গড়ার কারিগর অশ্বিনী বরাট ওরফে ভোলা দার। হগলী ব্রাঞ্চ স্কুলে পড়ার সময় ভোলাদার হাতে তৈরি হন সুরজিৎ, যাঁর ডাকনাম ছিল বিশু। বাবা সুহাস সেনগুপ্ত ছিলেন ডানলপ ইন্ডিয়ার কর্মী। তিনি নিজে চুটিয়ে ক্রিকেট এবং ফুটবল খেলেছেন। পারিবারিক ঘরানায় সমৃদ্ধ সুরজিৎ হুগলি মহসিন কলেজে পড়ার সময় কলকাতার রবার্ট হাডসন ক্লাবে খেলা শুরু করেন।
সেখান থেকে ফুটবলের আতুরঘর খিদিরপুরে যোগ দেন ভুতো দার সাহচর্যে। সেই সময় খিদিরপুরে প্রতিভার ছড়াছড়ি। প্রসূন বন্দোপাধ্যায়, শ্যামল ঘোষ, গৌতম সরকার, রঞ্জিত মুখোপাধ্যায় – কে নেই! সেখান থেকে শৈলেন মান্নার হাত ধরে মোহনবাগানে। পরের বছরই ইস্টবেঙ্গলে।
লাল হলুদ জার্সিতেই সুরজিতের বিচ্ছুরণ। সন্তোষ ট্রফিতে বাংলার হয়ে খেলেছেন। ভারতীয় দলের নিয়মিত সদস্য ছিলেন। গোল করিয়েছেন, নিজে অসাধারণ সব গোল করেছেন। দক্ষিণ কোরিয়া একাদশের বিরুদ্ধে তাঁর শূন্য ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল থেকে একটি গোল মার্কো ভ্যান বাসতেনকে মনে পড়ায়।
ফুটবল ছাড়ার পর সতীর্থদের মতো কোচিংয়ে আসেননি প্রয়াত প্রবাদপ্রতিম ফুটবলার। ময়দান থেকে নিজেকে কিছুটা দূরেই সরিয়ে রেখেছিলেন তিনি। যদিও তাঁর সময়ের বাকি ফুটবলারদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। সুরজিৎ সেনগুপ্ত ক্রীড়া সাংবাদিকতায়ও বলিষ্ঠ ছিলেন। আজকাল সংবাদপত্রে প্রশাসনিক পদে ছিলেন স্টেট ব্যাংক থেকে স্বেচ্ছাবসর নেওয়ার পর। তাঁর প্রয়াণে গভীর শোক নেমে এসেছে কলকাতা ময়দানে।
ফুটবলার হিসেবে তো বটেই, মানুষ সুরজিৎকে মিস করবে তাঁর দীর্ঘদিনের সতীর্থরা। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন, কিন্তু আশা ছিল ফিরে আসবেন। ময়দানের আরও এক নক্ষত্রপতনে শোকের ছায়া কলকাতা ফুটবল মহলে।
প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, সুরজিৎ আমার প্রাণের বন্ধু ছিল। আমাকে গোপাল বলে ডাকত। ভাবতে পারছি না ও আর নেই। আমার সঙ্গে ভীষণই হৃদ্যতা ছিল। কিন্তু ওকে এইভাবে আমি দেখতে পারব না। ও ফুটবলার হিসেবে তুলনাহীন ছিল। ওর মতো বড় মানের উইঙ্গার ভারতে নেই। ওর পায়ে বল কথা বলত। দিনের পর দিন আমরা একসঙ্গে খেলেছি। ও ইস্টবেঙ্গল অধিনায়ক ছিল, আমি মোহনবাগানের। মানুষ হিসেবে বড় মাপের ছিল। বিশ্বমানের ফুটবলার ছিল। কিন্তু সঠিক মূল্যায়ন হল না।
সুব্রত ভট্টাচার্য বলেন, সুরজিৎ আমাদের ছেড়ে চলে গেছে ভাবতে পারছি না। খুবই খারাপ লাগছে। এত বড় মাপের ফুটবলার ছিল। কিন্তু সঠিকভাবে ওকে কাজে লাগানো হল না। পরবর্তীতে কোনও ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। কেন একের পর এক ফুটবলার চলে যাচ্ছে সেটা আমাদের ভাবতে হবে। খেলা ছাড়ার পর ফুটবলারদের মানসিক দিকে কোনও সমস্যা হচ্ছে কিনা সেটা দেখতে হবে।
গৌতম সরকার বলেন, আমার সঙ্গে প্রচুর স্মৃতি। আমরা এমন একজনকে হারালাম যার শূন্যস্থান জীবনে পূরণ হবে না। বিরল ব্যক্তিত্ব ছিল। একাধারে ফুটবলার। এই কৃতিত্ব আর কারও আছে কিনা জানি না। অমূল্য সম্পদ ছিল। আমাদের সম্পর্ক ৫২ বছরের। সেই খিদিরপুর থেকে। ১৩-১৪ বছর আমরা একটানা একসঙ্গে খেলেছি। ওর চলে যাওয়া মেনে নেওয়া যায় না। অপূরণীয় ক্ষতি। এই শূন্যতা পূরণ হবে না।
ভাস্কর গাঙ্গুলি বলেন, ফুটবলার হিসেবে অসাধারণ ছিলই, খুব বড় মাপের মানুষ ছিল। সহকর্মীদের সঙ্গে কীভাবে মিশতে হয় জানত। সেটা সকলের শেখ উচিত। খুব তাড়াতাড়ি চলে গেল। ভাবতেই পারছি না। ময়দান এখন বড় মাপের ফুটবলার হারাল।