ঠান্ডার শহর থেকে ‘লেপার্ড ট্রেইল’—সুখিয়া পোখরির নতুন পরিচয়

ঠান্ডার শহর থেকে ‘লেপার্ড ট্রেইল’—সুখিয়া পোখরির নতুন পরিচয়

Facebook
Twitter
LinkedIn
Email
WhatsApp
Print
Telegram



উত্তরবঙ্গ – দার্জিলিংয়ের হিমশীতল শহর সুখিয়া পোখরি বহু বছর ধরেই পরিচিত ছিল সবচেয়ে ঠান্ডার জায়গা হিসেবে। কুয়াশা, বরফ আর কাঠের আগুন ছিল এখানকার চিরচেনা ছবি। সেই ঠান্ডার টানে পর্যটকের ভিড়ও ছিল প্রচুর। তবে গত কয়েক বছরে নীরবে বদলে গেছে এই ছোট পাহাড়ি শহরের প্রকৃতি ও পরিবেশ। আর সেই পরিবর্তনের সঙ্গে বদলে গেছে পর্যটনের চেহারাও। এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ঠান্ডা নয়, বরং ‘সুখিয়া পোখরি লেপার্ড ট্রেইল’।

রাতে গাড়ির আলোয় চিতার চোখ ধরা পড়া এখানে এখন আর নতুন কিছু নয়। দিনে বা রাতে প্রায় প্রতিদিনই স্থানীয়দের গাড়ির হেডলাইটে ধরা পড়ে ধূসর-হলদেটে লোম, লম্বা দুলতে থাকা লেজ আর স্থির দু’টি চোখ। মুহূর্তের মধ্যেই অন্ধকারে মিলিয়ে যায় সে। যা একসময় ছিল শোনা কথা, আজ তা এখানে প্রতিদিনের ঘটনা। স্থানীয়রা বলছেন, আগে শুধু গুজব ছিল চিতা থাকার, এখন তো বাড়ির পেছনের জঙ্গলেই রোজ হাঁটতে দেখা যায়।

একসময় সুখিয়া পোখরিকে ঘিরে থাকা পাহাড় ছিল প্রায় খোলা ঘাসজমি। রান্না ও গরম জলের জন্য কাঠ পোড়ানো ছিল দৈনন্দিন ব্যাপার, ফলে জঙ্গল কমছিল দ্রুত, আর দূরে সরে যাচ্ছিল বন্যপ্রাণ। কিন্তু উন্নত সড়ক, বাড়তি আয়, বিদ্যুৎ এবং এলপিজির ব্যবহার বাড়ায় কাঠ সংগ্রহ কমেছে; জঙ্গল ফিরেছে নিজের পুরনো রূপে। আর সেই ঘন সবুজ জঙ্গলেই ফিরেছে চিতা, মুনিয়া, সিভেট, বার্কিং ডিয়ার ও আরও বহু প্রাণী।

এই অঞ্চলে গবাদিপশুর সংখ্যা কম হওয়ায় চিতার প্রধান শিকার হয়ে উঠেছে রাস্তার কুকুর। ফলে আপাতত মানুষ-চিতার সংঘাত কম। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন—যদি কুকুর কমে যায়, চিতা অন্য শিকারের দিকে ঝুঁকতে পারে, আর একটি দুর্ঘটনাই মানুষের মনোভাব পুরো বদলে দিতে পারে।

পর্যটনের ক্ষেত্রেও এসেছে বড় পরিবর্তন। সোশ্যাল মিডিয়ার ভাইরাল ভিডিও, রাতের সাফারি স্টাইল ট্যুর আর প্রশিক্ষিত গাইডের সুবিধা মিলিয়ে সুখিয়া পোখরি এখন ওয়াইল্ডলাইফ ট্যুরিজমে নতুন ট্রেন্ড তৈরি করেছে। ‘লেপার্ড ট্রেইল প্যাকেজ’ এখন পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ। ভোর বা সন্ধ্যার গাইডেড ট্যুরে সেইসব জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে চিতার চলাফেরা বেশি। পর্যটকদের মতে, এত কাছে চিতা দেখার অভিজ্ঞতা উত্তরবঙ্গে আর কোথাও মেলে না। ফলে ক্রিসমাস থেকে নিউ ইয়ার পর্যন্ত হোটেলগুলো প্রায় সবই বুকড।

বনমন্ত্রী বীরবাহা হাঁসদা জানিয়েছেন, মানুষের সচেতনতা, কাঠ পোড়ানো কমা, এবং বনকর্মীদের নিরলস প্রচেষ্টায় জঙ্গল ফের ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, বন্যপ্রাণও বাড়ছে। তবে বিপদ বাড়াচ্ছে অগোছালো পর্যটন। চিতা দেখার নেশায় অনেকে আলো ঝলকানিতে ভিডিও তোলে, রাতে গভীর জঙ্গলে ঢোকে, যা প্রাণীর স্বাভাবিক আচরণে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।

সুখিয়া পোখরি ছাড়াও ঘুম, সোনাদা, মিরিক, লেপচাজগত—সব জায়গাতেই রাতের রাস্তায় চিতার চলাফেরা বেড়েছে। কোথাও চা-বাগানের শ্রমিক আক্রান্ত হয়েছেন, কোথাও বাড়িতে ঢুকে পড়ার ঘটনাও ঘটেছে। ক্যামেরা ট্র্যাপে জনবসতি ও রিজার্ভ ফরেস্ট—দুই জায়গাতেই সমানভাবে চিতার উপস্থিতি মিলছে। তবুও চিতার সংখ্যা, চলার পথ বা শিকারের ধরন—এই বিষয়ে এখনো বড়সড় গবেষণা হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিত গণনা, ক্যামেরা ট্র্যাপ ও জেনেটিক স্যাম্পলিং জরুরি।

সুখিয়া পোখরিতে পৌঁছানো বেশ সহজ। বাগডোগরা বিমানবন্দর ৭৪ কিমি দূরে, নিউ জলপাইগুড়ি রেলস্টেশন ৭৮ কিমি। দার্জিলিং থেকে ঘুম হয়ে মিরিক রোড ধরে পৌঁছানো যায় নির্বিঘ্নে। থাকার জন্য রয়েছে অসংখ্য হোটেল ও হোমস্টে। এদের মধ্যে নতুন একটি হোমস্টে—হিলটোপিয়া, যার আতিথেয়তা পর্যটকদের প্রশংসা কুড়োচ্ছে।

সুখিয়া পোখরি ভ্রমণের সেরা সময় অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর এবং ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ।

RECOMMENDED FOR YOU.....

Scroll to Top