বছর পঁয়ত্রিশের সৌরভ তালুকদার বেশ কিছুদিন ধরেই জ্বরে ভুগছিলেন। চিকিৎসক না দেখিয়ে ইন্টারনেট ঘেঁটে নিজের মতো অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া শুরু করলেন। তারপরেও জ্বর না কমায় অগত্যা দক্ষিণ কলকাতার এক চিকিৎসকের ক্লিনিকের দ্বারস্থ হন। আবার গড়িয়ার প্রিয়াঙ্কা কর্মকার পেটের যন্ত্রণা কমাতে ইন্টারনেট দেখে মুড়ি–মুড়কির মতো শুধু ব্যথা কমানোর ওষুধ খেয়ে চলেছিলেন। পরে চিকিৎসকের কাছে জানতে পারলেন গলব্লাডারের স্টোনের ফলেই ক্রমাগত যন্ত্রণা হচ্ছিল। এরকম আরও অসংখ্য উদাহরণ মিলবে, যাঁরা শুধু ইন্টারনেট–নির্ভর ওষুধ খেয়ে চলেছেন। সেই সঙ্গে নিজেদের জন্য ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনছেন বলে মত চিকিৎসকদের।
মেডিসিনের বিশিষ্ট চিকিৎসক সুকুমার মুখার্জি বলেন, ‘ইন্টারনেট থেকে একদিকে ভাল জ্ঞান হলেও অপর দিকে তার একাধিক কার্যবিবরণী থাকে। যার দরুন মানুষের মনে ভীতি জন্মায়। একই ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্পূর্ণ তালিকা দেখায়। যে কারণে রোগীরা ওষুধ খেতে চান না। সবসময় চিকিৎসককে দেখিয়েই ওষুধ খাওয়া উচিত। প্রেসক্রিপশন লেখার পর যাচাই করলে সেটা খারাপ বলব না, কিন্তু ইন্টারনেট দেখার পর ওষুধটা বন্ধ করে দেওয়া উচিত নয়। চিকিৎসক–রোগীর সম্পর্ক বিজ্ঞান–নির্ভর নয়, বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে।’
এসএসকেএম হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগের অধ্যাপক ডাঃ সুভাষচন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘ইন্টারনেট দেখে যদি কোনও রোগী বা তাঁর বাড়ির লোক রোগটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে চান সেটা ভাল বিষয়, অর্থাৎ সচেতনতা বাড়ছে। কিন্তু নেটে যা থাকে সবসময় তা বিজ্ঞানসম্মতভাবে ঠিক নয়। ডাক্তারি পাশ করে জ্ঞান অর্জন করার পর চিকিৎসক যে সিদ্ধান্তে আসবেন, সাধারণ রোগী কখনওই তা পারবেন না। নেট দেখে জ্ঞান হল কিন্তু কোনও সিদ্ধান্ত নিতে হলে বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। নিজের মতো ওষুধ খাওয়া কখনওই উচিত নয়, সেটার ফল সব থেকে মারাত্মক।’
ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের সাইকিয়াট্রি বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ডাঃ শর্মিলা সরকার বলেন, ‘এটা ঠিক যে, এখন ইন্টারনেট দেখে ওষুধ খাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। একদিকে চিকিৎসকদের ওপর মানুষের ভরসা কমেছে, অন্যদিকে ডিজিটাল মিডিয়ার দৌলতে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস জন্মে ‘আমি সব কিছু জানি’ এই বিষয়টিও কাজ করছে। ডাক্তার আদৌ ঠিক ওষুধ দিল কি না তা ইন্টারনেট দেখে মেলানোর প্রবণতাও ভীষণ বেড়েছে। চিকিৎসককে ফোন করে যাচাই করছেন রোগী। একই ওষুধ অনেক কারণেই দেওয়া হয়। নেট দেখে অনেকেই ওষুধ খাচ্ছেন না কিংবা কোর্স সম্পূর্ণ করছেন না। সচেতনতার অভাবে বাড়ছে বিপদ।’
মনস্তত্ত্ববিদ অনিন্দিতা রায়চৌধুরি বলেন, ‘ইন্টারনেট দেখে ওষুধ খাওয়ার প্রবণতার পেছনে অনেকগুলি কারণ আছে। মানুষের ধারণা, ইন্টারনেট বা উইকিপিডিয়াতে যা থাকে সেগুলোই একেবারে বেদবাক্য, এর বাইরে কিছু নেই। এখন সকলের হাতেই স্মার্ট ফোন, সুতরাং নিজেরাই ডাক্তারি করতে পারি এ ধরনের অত্যধিক আস্থা জন্মাচ্ছে। বুদ্ধি থাকলেও বোধের অভাব, বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি বিচার করতে পারছেন না। চিকিৎসক মেডিক্যাল সায়েন্স পড়ে বিশেষজ্ঞ হয়েছেন, তাঁরাই রোগটা ধরতে পারবেন। ডাক্তাররা কিছু জানেন না এটা ভাবা ঠিক নয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে বলব, চিকিৎসকেরাও দায়ী এই পরিস্থিতির জন্য। কারণ চিকিৎসকদের একাংশ এখন এত বেশিই বাণিজ্যিক হয়ে গেছেন যে, সাধারণ মানুষ অহেতুক খরচের ভয়ে ভরসা হারাচ্ছেন।’