মিডিয়ার সেকাল একাল সাংবাদিকতা কি আদৌ কোন মহান পেশা। আজ সহস্র মনে হাজারো প্রশ্ন যে, সাংবাদিককুল সত্যিই কি কোন এক মহান পেশার অংশীদার। কেননা চারিদিকে এত মিডিয়া যার মধ্যে পাঠক দর্শক দিশেহারা। তবে চার বা পাঁচ দশক আগে আমরা যখন এই পেশায় যুক্ত হয়ে পড়ি তখন সত্যিই সমাজের কাছে সংবাদ পেশায় যুক্ত ব্যাক্তিদের যথেষ্ট মান সম্মান বিশ্বাস ছিল। আম আদমির একাংশের ধারণা ছিল যে, সাংবাদিককুল মহান, আদর্শবাদী, নোবেল প্রফেশনার। আবার অন্য একটি অংশ তখনো ভাবতেন যে, সাংবাদিককুল সুবিধাবাদী, লোভী, ভোগী, স্বার্থপর, ক্ষমতাশালীদের লেজুড় ইত্যাদি।
এইভাবেই এই পেশা নানান স্ববিরোধী বিশেষণে ভূষিত এক বিশেষ শ্রেণীর ‘নাগরিক’ হিসাবে বিধৃত উদ্ধৃত উক্ত ব্যক্ত চিহ্নিত বিশেষ পেশাদারকুল। তারা এক ভিন্ন গ্রহের মানুষ হিসাবে সমধিক পরিগণিত হয়েন প্রায়শ:। তবুও সকালে ব্রেকফাষ্টে আর রাতে শয়ন প্রক্কালে হেডলাইন দেখে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যাবার লোকগুলির আজও সাংবাদিক সম্পর্কে ধারণার ইতরবিশেষ পরিবর্তন হয়েছে বলে, আমার অন্তত মনে হয় না। কংগ্রেস, বাম ও বতর্মান আমলে ধারণা একই আছে। কোন ইতরবিশেষ নেই। মাঝখানে ‘কাবাব মে হাড্ডি সোশ্যাল মিডিয়া। এর জনপ্রিয়তার চেয়ে জন-.অবিশ্বাস প্রগাঢ়।’
বাম আমলে জ্যোতি বসু সংবাদপত্রকে খুব একটা পাত্তা দিতেন না। তবে জনসভায় গিয়ে দেখতাম সাংবাদিকদের চার লাইনে সমালোচনা করবেনই। বিশেষ করে আনন্দবাজারকে। বউবাজার ম্যাসাকার কান্ডের জেলের আসামি কুখ্যাত রশিদ খান সম্পর্কে একটি সংবাদ পরিবেশিত হয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকায় । যার প্রেক্ষিতে ওই সংবাদ প্রকাশের জেরে বসু আনন্দবাজারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন আলিপুর জেলা জজের কাছে। তখন জেলার সরকারি পক্ষের উকিল জ্যোতি রায় জ্যোতি বসুর হয়ে মামলা করেছিলেন। পাঁচ কোটি টাকার মানহানির মামলা। ফলে মিডিয়া বিষয়ে বসু ছিলেন ব্যতিক্রমী।
আলিমুদ্দিন গেলে বিশেষ সাংবাদিকদের লাল চা মিলত। সবার নয়। সরকারের কোন বড় সাংবাদিক বৈঠক বা প্রেস মিট থাকলে খাবার প্যাকেট থাকত। কখনও সখনও গিফট প্যাকেটও থাকত। ঠাট্টা করে একে ‘পোস্ত’ বলা হত। অল্প কিছু সাংবাদিক তা গ্রহণ করতেন না। বেশীরভাগ সাংবাদিক, চিত্র সাংবাদিক নিতেন। খুব কম সংখ্যক এড়িয়ে যেতেন। যারা নিতেন তারা তা বেশ গর্ব অনুভব করতেন।
বাম আমলে সাংবাদিকদের প্রপ্যের সিংহভাগ ভোগ করতেন দায়িত্ব প্রাপ্ত সরকারি কর্মীদের একাংশ। সাংবাদিকদের তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক ভাবা হত সেই আমলে। দলীয় মুখপত্র ও তার সাংবাদিক স্পেশাল ট্রিটমেন্ট পেতেন। যা অন্যরা পেতেন না।
২০১১ মমতা ব্যানার্জী ক্ষমতায় আসার পর মমতা-মিডিয়া সম্পর্ক নতুন মাত্রা পেল। বলা ভাল দিদি-মিডিয়া সুসম্পর্ক স্থাপিত হল। ২০১৩ দিদি পুজোয় সাংবাদিক বন্ধুদের নতুন বস্ত্র প্রদান করতে শুরু করেন। যারা রাইটার্স ও পরে নবান্ন-তে সাংবাদিকতা করতেন তারা এই মহার্ঘ পুরষ্কার পেতেন। এখন কলকাতার সাংবাদিক পান দুহাজার টাকা। জেলার এক হাজার টাকা। তবে অ্যক্রিডিটেশন কার্ড থাকতে হবে। দিদির সঙ্গে সফরে গেলে দেদার ভুরিভোজ হত। এখনো হয়।
তথ্য দপ্তরের কর্মীরা খুব আন্তরিক। সঙ্গে দিদি একজন সাংবাদিক প্রতিনিধি রেখেছেন। পি কে সি তার নাম। টুরগুলোতে কোঅর্ডিনেশন রাখেন তিনি । যা বাম আমলে স্বপ্নেও ভাবা যায়নি। বরং একটি প্যাকেট দিলে তার হিসেব নিত। খবর না বেরোলে কথা শোনাত। কংগ্রেস আমলে ছিল হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র সংবাদ পত্র। ছিল বউমা ভাদ্রবধু সম্পর্ক সংবাদ মাধ্যম ও সরকারের মধ্যে।
এমনও শুনতে হয়েছে, ‘খেয়ে গেলেন খবরটা তো করলেন না। সকলেই জানেন সাংবাদিক খবর পাঠালেও সব সময় তা কাগজে জায়গা পায়না। এই অপমান সয়ে সাংবাদিকতা করতে হয়েছে। এমন কি রুচিশীল শিক্ষানুরাগী বুদ্ধদেবের আমলেও ঘটেছে। দুচারজন নির্দিষ্ট পছন্দের সাংবাদিক ছাড়া তার নিকটবর্তী হওয়া দু:সাধ্য ছিল।
তার আত্মগরিমা শ্লাঘার পর্যায়ে ছিল। বইপড়া পরিমার্জিত পরিশিলিত লেখক বুদ্ধিজীবী মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁর স্বীয় গর্ব তার কন্যাকেও গর্বিত হতে প্রভাবিত করেছিল। তার মন্ত্রীসভার এক মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী বলতে সাহস করতেন,’ সাংবাদিকরা অর্ধশিক্ষিত’। তখন এই পেশার কেউ প্রতিবাদ করেননি। অন্তত মিছিল তো বের করেননি। তবে ইদানিং মুখ্যমন্ত্রী মাঝে মাঝে সমালোচনা করে বসেন কিছু নির্দিষ্ট সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যমকে। অনিল বিশ্বাস কিছুটা প্রো-মিডিয়া তথা মিডিয়ামুখী ছিলেন। তার সময়ে অনেক বাংলা টিভি চ্যানেল চালু হয়েছিল। যাদের অধিকাংশ এখনো টিকে আছে। তার মধ্যে বামফ্রন্ট বিরোধী চ্যানেলও ছিল। অথচ সরকার বিরোধীতার জন্য কোন অসুবিধায় পড়তে হয়নি টিভি কতৃপক্ষকে।
তবুও একটা ফারাক আছে। এখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর কোন কর্মসূচিতে ও সফরে গেলে তিনি আলাদা করে মিডিয়ার লোকেদের খোঁজ রাখেন। শুধু খোঁজ রেখেই দায়িত্ব সারেন তা নয়। সাংবাদিককুলের সর্বক্ষণ খোঁজ খবর রাখেন। যেভাবে বাড়ির সর্বোচ্চ অভিভাবক খবর রাখেন, তদারকি করেন, দিদিও সেভাবেই আন্তিকতা দেখান। টুথপেষ্ট থেকে দৈনন্দিনের প্রয়োজনীয় ও খুচরো প্রয়োজনের ‘কিট ব্যাগ’ দেওয়া হয় সাংবাদিকদের সরকারি উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে।
আরও পড়ুন – বাঁকুড়ার পোড়া পাহাড়ে রহস্যময় গুহার সন্ধান, আদিম মানুষের বসবাসস্থল দাবী স্থানীয়দের একাংশের
যা কেউ কংগ্রেস বা বামফ্রন্ট শাসনে কল্পনাও করতে পারতেন না। সম্ভবও ছিল না। সাংবাদিকদের সুবিধার পরিবর্তে পদে পদে অসুবিধা করতে পারলে পুরষ্কার পাওয়া যেত। বোধহয় মহিলা মুখ্যমন্ত্রী বলেই এই মাতৃসম কেয়ার ও মনোযোগ পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। দিদি তো মাতৃসমা।
এমনটি আগে দেখা যেতনা বললে সব বলা হয়না। আগে এই ধরনের আতিথেয়তা স্বপ্নের অতীত ছিল। যারা এই তিন পর্যয়ের শাসকদের আমলে সাংবাদিকতা করেছেন তারা এই পার্থক্য অনুধাবন করতে পারবেন। অন্য কেউ নয়। বহু সাংবাদিক ব্যাক্তিগত সমস্যায় পড়লে তাকে মমতা সর্বৈবভাবে সর্বপ্রকার সাহায্য করেছেন যা আর কোন সরকারের আমলে দেখা যায়নি। আগে হলেও হয়ত তা এক আধজনের ভাগ্যে জুটেছে। এত বেশী সংখ্যায় কখনও নয়।
এখন এত ভাল সহযোগিতা, আতিথেয়তার ফলে
সংবাদ সংগ্রহে কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরী হয় কিনা! বা এতসব ভাল আয়োজন প্রয়োজন মেটানোর কোন প্রতিদান খবরের গলা কেটে পরিশোধ করতে হয় কিনা এই প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মনে স্বাভাবিকভাবে জাগ্রত হতে পারে। সঠিক উত্তর মিডিয়াপ্রেমী পাঠককুল ও দর্শকরাই দিতে পারবেন।
তবে সাংবাদিক হিসাবে বলতে পারি কাজের পরিবেশ বদলেছে। সাংবাদিকতার যান্ত্রিকতা আমাদের যেভাবে কোণঠাসা করেছিল। এখন তা থেকে অনেকটা মুক্তি। সাময়িক কিনা সে বিচার সময়ের হাতে ছেড়ে দিয়ে মনের আরাম উপভোগ করি না কেন @।