মেটিয়াবুরুজ বিরিয়ানিতে আলু, হায়দেরাবাদ, লক্ষ্ণৌ, প্যারিসের বিরিয়ানীতে নেই. মেটিয়াবুরুজের বিরিয়ানী প্যারিস, লক্ষ্ণৌ ও হায়দারাবাদের বিরিয়ানী থেকে আলাদা। কী সেই পার্থক্য ! একমাত্র আলু। মেটিয়াবুরুজের বিরিয়ানীতে আলু কেন ! এই ঘটনার আগে মেটিয়াবুরুজ বিরিয়ানী রান্নার প্রণালীটা বা রেসিপীটা বলা যাক।
দিল্লীর সেফ নতুন প্রণালীতে এই রান্নার সুলুকসন্ধান পরে ফাঁস করে দেন। পরিষ্কার করে দেন এর অপূর্ব স্বাদমাহাত্ম। যে পাত্রে বিরিয়ানী রান্না হবে সেই পাত্রে আলু চাল মাংস মশলা দিয়ে পাত্রের মুখ সিল করে দিতে হবে। এরফলে স্টিম বা বাষ্প বেরিয়ে যেতে পারবে না। বাষ্পের চাপে ও তাপে আলু, ভাত, মাংসের মধ্যে, জাফরানি, ঘি, তেল, ও অন্যান্য মশলা শুষে যায়। স্বাদ হয় দারুণ। তা খেয়ে তৃপ্ত রাজা ওয়াজেদ আলী শাহ সেফকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আজ থেকে তার বিরিয়ানীতে আলু অবশ্যই থাকবে। সেদিন থেকেই এই বিরিয়ানী অন্য সব বিরিয়ানী থেকে আলাদা হয়ে যায়। রান্নার এই নতুন শৈলি ও আলুর যোগের কারণে মেটিয়াবুরুজ বিরিয়ানী বলে নতুন নামকরণ হয়ে যায় শাহী বিরিয়ানীর।
আর এই আলুর বিরিয়ানী হৈ হৈ করে সারা বাংলায় জনপ্রিয় হয়ে গেল। সারাদেশেও ছড়িয়ে পড়ল এর স্বাদ ও গুণের কথা। বিশেষ করে আলুর প্রয়োগ বিরিয়ানীতে। লক্ষ্ণৌ বিরিয়ানী খুব পাইসি। হায়দারাবাদি নিযামের বিরিয়ানীও পাইসি বা মশলাযুক্ত। তবে খুব আভিজাত্যের মোড়কে বাধা। বিশেষত্ব সব রান্না হয় মাটির পাত্রে। সব কাঁচা জিনিস দেওয়া হয়। কাঁচা চাল,মাংস, মশলা সব একসঙ্গে দিয়ে স্টিমের সাহায্যে রান্না করা হয়। তাই এর নাম কাচ্চি বিরিয়ানী। নিযামদের এই বিরিয়ানী ছিল সবথেকে আকর্ষণপূর্ণ। এরসঙ্গে বিভিন্ন সময় আরো অনেক কিছু যোগ করে বৈচিত্র্য বাড়ানো হয়েছে। অন্ধ্র তেলেঙ্গনায় এই বিরিয়ানী এখনো খুব বিখ্যাত। ইদানীং নিরামিষ বিরিয়ানীর চল হয়েছে।
আরও পড়ুন – মিঠুনের সেটে খাবার দিতেন বাবা, এখন আমি তাঁর সিনেমার প্রযোজক : দেব
এসব সত্বেও ওয়াজেদ আলী শাহর আলুর কোন বিকল্প ছিল না। এখনো নেই। বৃটিশের পেনশন পাওয়া রাজত্ব হারানো নিশাপুর রাজ্যের শেষ রাজা ও বাংলার শেষ নবাব ওয়াজেদ আলী শাহর বিরিয়ানী এত জনপ্রিয় হবে তা কেউ ভালভাবে মেনে নেয়নি ! বৃটিশ অভিমানি। বৃটিশ পরশ্রীকাতর। বৃটিশ প্রতাহিংসাপরায়ণ। আলু ভারতে এনেছিল পর্তুগীজরা ষোল শতাব্দীতে। আঠারো শতাব্দিতে তা বেশ জনপ্রিয় হয়। আর আজ হুগলি জেলার আলু দেশবিখ্যাত।
আলুর গল্প বা বিরিয়ানীর গল্প কেন ! জিভে জল আসা বিরিয়ানী নিয়ে হঠাৎ আলোচনায় পাঠক বিব্রত হতে পারেন। বলতে পারেন, রুজিরা, মেনকার সিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদ, পামেলা গোস্বামী ও দুইপুত্রসহ রাকেশ সিংয়ের গ্রেপ্তারের মত ৪০০×৪০ ভোল্টের রাজনৈতিক উত্তাপের সময়ে এই আলোচনা কেন ! তাও নিরামিষ আলু নিয়ে ! আলু মানে হুগলি। হুগলির আলুর সঙ্গে বিখ্যাত এখানকার ফুরফুরা শরিফ। হযরত আবু বক্কর কেবলার শাহী দরগা যা ভারতের মধ্যে দ্বিতীয় জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম তীর্থস্থান। সেখানকার কনিষ্ঠ এক পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী হঠাৎ বাংলার রাজনীতিতে গুরুত্ব পেতে শুরু করেছেন। তার জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়।
সেই ঈর্ষা হঠাৎ করে আরো খানিক বেড়ে গেল এক হায়দারাবাদীর জন্য। মিম প্রধান এখানে এসে সব দায় দায়িত্ব আব্বাসের ঘাড়ে দিয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে আব্বাসের বিরিয়ানীতে কংগ্রেস সিপিএম আলু হয়ে ঢোকার চেষ্টা করছে। এতে তাল কাটতে পারে হায়দারাবাদের। তাদের আলুর বিরিয়ানী আর পছন্দ কিনা সেটা নিয়েই রাজনৈতিক প্রশ্ন। কেননা সিপিএম ও বাম কংগ্রেস বাংলার আলুর বিরিয়ানী আব্বাসকে হায়দারাবাদের বিরিয়ানী ওয়াইশির হাতে ছেড়ে দিতে নারাজ।
বুধবার মেটিয়াবুরুজ জনসভায় আব্বাসের হাজির থাকার নিশ্চিত কোন খবর নেই। অফিস সূত্রে বলা হয়েছে তিনি যাবেন না। বামেদের ব্রিগেডে যাবার কথাও দেননি তিনি। আন্দাজ যে তিনি যেতে পারেন ব্রিগেডে। জোটের বিরিয়ানী মধ্যে ইনসাফ পার্টির আলু যোগ করতে নেতাদের চেষ্টার কসুর নেই। তৃণমূলও হাল ছাড়েনি বলে খবর। তবে জোটের এই দুর্দিনে আব্বাস কেন হাত মেলাবে। কংগ্রেস সিপিএম তো জনসমর্থনের বিচারে গরীব পার্টি। গরীবের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আরো গরীব হওয়া কেন ইন্ডিয়ান ইনসাফ পার্টির।
আলুর বিরিয়ানীর কথা শুনে বৃটিশরা খেপে গিয়ে বলতে শুরু করল মাংস বেশী দিলে বেশী ব্যয় হবে। তাই গরীব নবাব ওয়াজেদ আলি, আলু দিয়ে বিরিয়ানী খাচ্ছেন। আসলে এটা ডাহা মিথ্যে ছিল। বিরিয়ানীর নতুন প্রণালি এত প্রিয় হবে তা কেউ বুঝতে পারেনি। এর সুনাম নষ্ঠ করতে এই অপপ্রচার শুরু করে বৃটিশ সেফরা। সব জানা সত্বেও এসব বলার কারণ যে নবাবকে ছোট করা খাটো করা তা স্পষ্ট। যে নবাব বছরে ১২ লক্ষ টাকা বৃটিশ সরকারের কাছ থেকে পেনশন পান। যিনি বৃটিশ প্রভুদের কাছ থেকে উপমহাদেশের মধ্যে সব থেকে বেশী অর্থ পেনশন পান। যিনি পচিশ শতাংশ ব্যয় করতেন তার নিজের হাতেগড়া চিড়িয়াখানার পশুদের রক্ষণাফেক্ষণ, ভরণপোষণে জন্য, তার কাছে মাংসের ব্যয় কমাতে বিরিয়ানীতে আলু প্রয়োগ যুক্তির সঙ্গে খাপ খায় না। পশুপ্রেমী শাহ নিজের পছন্দ মত প্রাণীদের রাখতেন। ৯১১ টি প্রাণী ছিল তার প্রাণী উদ্যানে। ১০২ প্রজাতির প্রাণি ছিল ১৯২১তে। এই পশুপক্ষীদের নিজের পেনশনের টাকায় রক্ষণাবেক্ষণ করতে বার্ষিক ব্যয় ছিল বছরে ৪ লক্ষ টাকা। ব্যয় করতেন তার প্রিয় চিড়িয়াখানা বা প্রাণী উদ্যানের জন্য।
যদিও এখন অসংখ্য পশুপাখী ঠাই পেয়েছে। এগার থেকে বার লক্ষ দর্শক বছরে ভিজিট করেন এখন। তখন ছিল অউধ। আর এখন উত্তর প্রদেশে এই উদ্যান। এখন আছে ৪৬৩ স্থন্যপায়ী, ২৯৮ প্রজাতির পাখী। ৭২ সরিসৃপ ও বাঘ সিংহ হরিণ হাতি ওরাংওটাং মিলিয়ে ৯৭ প্রজাতির প্রাণী। মেটিয়াবুরুজ বিরিয়ানী তাও আলুর বিরিয়ানী নিয়ে শুরু করে চলে গেলাম মেটিয়াবুরুজ ইতিহাসে। কেন? বাংলার শেষ নবাব সম্পর্কে কিছু না বললে বিরিয়ানীর কথা সম্পূর্ণ হবেনা। সম্পূর্ণ হবেনা মেটিয়াবুরুজের কথা। বলা হবেনা একদা রাজাকার ব্যারিষ্টার অসাউদ্দিন ওয়াশির কথা।
হায়দারাবাদের বিরিয়ানী নিয়ে বলতে যাবার আগে মেটিয়াবুরুজের আলু নিয়ে শুরু করা যাক। আলু এসেছে সুরাট থেকে। পর্তুগীজরা প্রথম ভারতে এই আলুর চাষ শুরু করেন। সেই আলু চলে আসে বাংলায়। তাই দিয়ে নবাবের বিরিয়ানী। আর আজ তা ইতিহাস। ঠিক ১০০ বছর পর মনে হচ্ছে আলোচনাটা একটু অন্যখাতে বইছে। ইরান তথা পারস্যের বিরিয়ানী একসময় এখানে বিখ্যাত ছিল। মেটিবুরুজ তথা মাটির কেল্লা বা মাটির দুর্গ শিয়াদের (ইরানের শিয়ি কিনা জানা যায় নি) শতাধিক বছরের পুরনো জনপদ বলে বাংলায় খ্যাত। যা আজ পযর্ন্ত অটুট কলকাতার এই দক্ষিণভাগে।
দেখা যাক অত্যন্ত সম্মানভূষিত হায়দারাবাদী বিরিয়ানী ওয়াইশির দশা কী হয়। খুব পাইসি, খুব রিচ হায়দারাবাদের রেসিপি অন্যরকম। বৃটিশের কাছে মাথা না নোয়ানো নিযামের আভিজাত্য ছিল রঁসুই ঘরেও। ওসমান আলী খান সপ্তম ও শেষ নিযাম। মুঘল, তুর্কী মারাটাওয়াড়া ও তেলেগু কুশাইন মিলে এই বিরিয়ানী যার তৈরী। যার সঙ্গে ইরানী বিরিয়ানীর মেলবন্ধন আছে। এই বিরিয়ানীর সঙ্গে লক্ষ্ণৌ বিরিয়ানী মিল আছে। তবে তা মেটিয়াবুরুজের থেকে আলাদা। আলাদার কারণ এই সব বিরিয়ানীতে কিন্তু আলু দেবার চল ছিল না। আজও নেই। আলুর জনপ্রিয়তার মর্ম এরা বুঝতে পারেননি। আলু এতটা প্রিয় যে এখন ভারতের মানুষ বছরে মাথা পিছু ২৪ কেজি আলু খান। ১৪ কেজি পেঁয়াজ ১২কেজি মাছ, ৫ কেজি মাংস খান বছরে।
এই নিযামি ঘরানা কী মেটিয়াবুরুজ মেনে নেবে।মিনি পাকিস্তান বলে ফিরাদ হাকিম সেদিন সত্যি কথাটা বলেছিলেন। এই এলাকার মানুষ মনে করেন এখনো তারা ওয়াজেদ আলী শাহর জমানায় আছেন। কিন্তু তারা একটা কথা ঠিকই বলেছেন স্বাধীনতার পর প্রিন্সলে স্টেট হায়াদারাবাদ পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকেছিল। কাসমী রাজভির নেতৃত্বে মুসলিম রাজাকাররা মিম এর নেতৃত্বে মিছিল বের করেছিল পাকিস্তানের সঙ্গে চলে যাবার জন্য। মাত্র ২০ শতাংশ মুসলিম, ৮০ আশি শতাংশ হিন্দু নিয়ে এই রাজ্য কী করে পাকিস্তানে যাবে ! আগুন জ্বালতে থাকে। মিম ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে হিন্দু এলাকায়। এই সশস্ত্র মিছিলের মোকাবেলায় পুলিশ নিয়ে তৎপর হলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভ ভাই প্যাটেল।
পুলিশের হস্তক্ষেপে বশ্যতা স্বীকার করেন নিযাম। শেষ নিযামকে রাজপ্রমুখ করে হায়দারাবাদ ভারতের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। পরে ভাগ হয়ে এখন তেলেঙ্গনা রাজ্যের সঙ্গে মিশেছে হায়দারাবাদ। রাজভির বংশধররা মিম এর সংগঠনের দখল নেয়। তারই উত্তর পুরুষ এখনকার আসাউদ্দিন, আকবরউদ্দিন ওয়াইশি।
ওয়াইশি ভাইয়েরা আজ ভারতের মুসলিম জনতার উদ্ধার কর্তা হিসাবে দাবি করেন। তিনি বুধবার আসছেন মেটিয়াবুরুজ। মাটির কেল্লায়। গার্ডেনরিচ খিদিরপুর এলাকায় শিয়াসুন্নিদের আধিপত্য। সকলে জানেন যে এখনো তারা নববাবের রাজত্বে আছেন। কোন সমস্যা নেই তাদের ভাবনায়। এখানে প্রিন্সেপ ঘাট, বিচালি ঘাট, এমনকি আছে ভুতঘাট। বহুঘাটের বহু জল, পানি পান করে এখানকার মানুষেরা পুরো সিজিন্ড হয়ে আছেন। অবাঙালি হলেও এরা বাঙালির সঙ্গে মিলে গিয়েছেন। তবুও আভিজাত্যে কোথাও একটি সূক্ষ্ম বিভাজন রয়ে গেছে।
পুলিশ অফিসার বিনোদ মেহতার হত্যার এই জমিতে এখনো পুলিশের ট্রাফিক আইন অচল। এখানে পুলিশ ভয়েভয়ে থাকে। আসাউদ্দিন ওয়াইশি কোন ভাষায় এই মুসলিম জনপদকে পথ দেখান সেটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি হগলির পীরজাদা আব্বাসউদ্দিন কতটা এই হয়াদারাবাদী ঘরানার সঙ্গে চলতে পারবেন, কী আদৌ চলতে পারবেন না তা গুরুত্বপূর্ণ। ওয়াইশির সভায় না এলেও কী পরিষ্কার হবে তাদের সম্পর্ক ! প্রশ্ন প্রার্থী ঠিক করা অবধি কী অপেক্ষা করতে হবে ! বহুঘাটের পানি খাওয়া মিম সম্রাট এই বিচালি ঘাট, ভূতঘাটের মানুষরা বুধবার মিমের পশ্চিমবঙ্গের ভূত ভবিষ্যৎ অনেকটা ঠিক করে দেবেন। বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই মেটিয়াবুরুজের মাটিতে নতুন কোন ইতিহাসের শুরুয়াত হয় কিনা অপেক্ষা তার। তাই মেটিয়াবুরুজের বিরিয়ানীর প্রসঙ্গ টেনে এনে রাজনৈতিক লেখাটায় ইতিহাসের মাপজোক করার চেষ্টা। সঙ্গে জিভে জল আসা মেটিয়াবুরুজ, হায়দারাবাদ, লক্ষ্ণৌ, পারস্যের বিরিয়ানীর রেসিপি।। ।