জাতপাতের শ্রেণী বিভেদ করতেন না নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক মানবতা। ১৯১৪ গরমের ছুটি পড়তে বাড়িকে লুকিয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে নিপাত্তা। তাও আবার তীর্থযাত্রা। এবং সেই ফাঁকে গুরু খোঁজা। পাক্কা দু’মাস উত্তর ভারতের বেশ কিছু তীর্থ ঘুরেও গুরু অধরা রয়েই গেল। তার বদলে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রত্যাবর্তন। পরিচয় পেলেন হিন্দু সমাজের মৌলিক ত্রুটিগুলির। তথাকথিত সাধু-সন্ন্যাসীদের ছুঁৎমার্গ, কথা ও কাজে ফারাক সুভাষকে বিব্রত করেছে।
তিনি লিখেছেন, “অধিকতর বিজ্ঞান লাভ করে আমি বাড়ি ফিরেছিলাম এবং সন্ন্যাসী ও সংসারত্যাগীদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা অনেকখানি হ্রাস পেয়েছিল। ভালোই হয়েছিল যে নিজের কার্যের দ্বারাই আমি এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম, কেননা এমন অনেক কিছুই আছে, যা আমাদের নিজেদেরই শিখতে হয়”। এরপরই তিনি বাবার সঙ্গে কথায়-কথায় বলেছেন, “বিবেকানন্দের ‘আইডিয়াল’ হচ্ছে আমার ‘আইডিয়াল”।
যাঁকে তিনি মাথায় আসন দিয়েছেন, তাঁর অভ্যন্তরে কোনো সঙ্কীর্ণতার ঠাঁই নেই। রংপুর-এ বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে (৩০ মার্চ ১৯২৯) সভাপতির ভাষণে সুভাষচন্দ্র বলেন, “নিজের দেশের নবীন জাতি সৃষ্টির কাজ ও বিবেকানন্দ আরম্ভ করিয়াছিলেন।…” একই চিন্তার বশবর্তী হয়ে সুভাষ শ্রেণী-বিশেষের মধ্যে দৃষ্টি আটকে না রেখে গোটা সমাজের মধ্যে সাধারণ মানুষ অথবা নাগরিকের শক্তি খুঁজলেন। অর্থাৎ দেশের সার্বিক উন্নতিতে সর্বাধিক প্রয়োজন ‘পাওয়ার অব দ্য পিপল’। যার সঙ্গে জাতপাতের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই।
স্বেচ্ছাবাহিনীতে সেপাইরা প্রথম পর্যায়ে আচার-বিচার ইত্যাদিকে একটু বেশি নজর দিত। কিন্তু খুব কম সময়ের ব্যবধানে তা সম্পূর্ণ উধাও হয়ে গেল। এর প্রধান কারণ ছিল সুভাষচন্দ্রের দৃঢ় সংকল্প। একজন সেপাইকে বলতে শোনা গিয়েছিল, “ভারতবর্ষে আমাদের একশোটা ধর্ম, একশোটা দেবতা, কিন্তু এখানে সব কিছুই জয়হিন্দ”। কাবুলে থাকার সময় সুভাষচন্দ্রকে একজন প্রশ্ন করেছিল যে, ভারতবর্ষে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক দলাদলি থাকতে দেশ কী করে ঐক্যবদ্ধ হবে? উত্তরে তিনি (সুভাষচন্দ্র) বলেছিলেন, “দেশে যতদিন তৃতীয়পক্ষ, অর্থাৎ ব্রিটিশ আছে, ততদিন দলাদলি যাবে না। বিভেদ দিন-দিন বাড়বে।
যদি কোনো ডিক্টেটর বিশ বছর ধরে ভারতবর্ষকে কড়া শাসনে রাখতে পারে, একমাত্র তা হলেই এই বিভেদ ঘুচতে পারে”।… তৎকালীন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ও সুভাষচন্দ্রবসু তাঁর অ-সাম্প্রদায়িক মানসিকতায় ফাটল ধরতে দেননি। তিনি বলেছিলেন, “অদূর ভবিষ্যতে ভারতবর্ষ পৃথিবীর ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করবে।
আমরা সবাই জানি যে বিশ্বসভ্যতায় সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের দান সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের পরিকল্পনা। তেমনই অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সের ‘মুক্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বে’র আদর্শ…পৃথিবীর সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পরবর্তী উল্লেখযোগ্য় অবদান ভারতবর্ষকেই করতে হবে”। যে সভ্যতা ও সংস্কৃতি অ-সাম্প্রদায়িক ভিতের উপরেই পোক্ত, বৈষম্যের উপাদানে উইপোকা ধরবে।