
ঘরকুনো বলে বাঙালির অপবাদ থাকলেও এই বাঙালিরই কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। পকেটের জোর না থাকলেও অচেনাকে চেনা আর অজানাকে জানার অদম্য ইচ্ছায় এই বাঙালিই পাড়ি দিয়েছে হাজার হাজার মাইল পথ। ছুটে চলার অন্তহীন ইচ্ছের কাছে যেখানে হার মানে আর্থিক অসঙ্গতিও। এমনই এক অন্যরকম বাঙালি দক্ষিণ কলকাতার চেতলা এলাকার বাসিন্দা পরিমল কাঞ্জি (Parimal Kanji)। সাইকেলেই ভারত ভ্রমণ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন এই আজব মানুষটি।
স্টোভ, গ্যাস ওভেন, প্রেশার কুকার সারাইয়ের ছোট্ট একটা দোকান রয়েছে পরিমলের। কাজের সূত্রে মাঝে মাঝেই নিজের আদ্যিকালের সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পরতেন কাছে-দূরের কর্মস্থলে। বৃহত্তর জগতের হাতছানি যখন ক্রমশ বাউন্ডুলে মনটাকে আনচান করে তুলছে ঠিক তখনই ভারত ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন পঞ্চান্নটা বসন্ত পেরিয়ে আসা পরিমল কাঞ্জি (Parimal Kanji)। সঙ্গী বলতে নিজের আদ্যিকালের সাইকেল,কিছু জামাকাপড়, শুকনো খাবার আর বন্ধুর দেওয়া সামান্য হাতখরচার টাকা।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে কলকাতা থেকে যাত্রা শুরু করে ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কেরল, কর্নাটক,গোয়া,মহারাষ্ট্র, গুজরাত,রাজস্থান,পঞ্জাব,জম্মু-কাশ্মীর, শ্রীনগর হয়ে পৌঁছন লাদাখে। ফিরতি পথে নেপাল হয়ে কলকাতা ফেরার পথে মঙ্গলবার তিনি আসেন রায়গঞ্জে। এদিন শহরের বুকে তাকে সম্বর্ধনা জানান তার অনুরাগীরা৷
শঙ্কর ধর নামে এক পর্বতারোহী বলেন,” পরিমল বাবু বাংলার গর্ব৷ কী পরিমান ইচ্ছাশক্তি থাকলে সাইকেলে চেপে ভারত ভ্রমণের সাহস দেখানো যায় তা পরিমল বাবুর কাছ থেকেই শিখতে পেরেছি৷ তিনিই আমাদের অনুপ্রেরণা। দীর্ঘ এই যাত্রা পথে পরিমল কাঞ্জি যেমন খুঁজে পেয়েছেন ভারতবর্ষের অন্তরাত্মাকে তেমনি নানা অভিজ্ঞতা পূর্ণ করেছে পিঠের রুকস্যাক ব্যাগকে। কোনও মানুষের ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছেন আবার অনেকের ব্যবহার দাগ কেটে গিয়েছে হৃদয়ের গভীরে।
পরিমল বাবুর কথায়, “এসব নিয়েই তো জীবন। চলার পথে বহু মানুষের সহযোগিতা পেয়েছি। এবার কলকাতায় ফিরে সাময়িক বিরতি। তারপর অদেখা, অসম্পূর্ন স্থানগুলোকে নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়বেন। সমতল রাস্তায় দিনে একশো আশি কিলোমিটার আর পাহাড়ি অঞ্চলে ষাট কিলোমিটার সাইকেল চালিয়েও ক্লান্ত নন তিনি। বরং বদ্ধ ঘরের বাইরের জগতটাকে দেখার,জানার একটা পাগলামি ক্রমশ তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় এই মানুষটাকে।
আর ও পড়ুন ; ২১এর ভোটে হেরেও TMC-কে টেক্কা দিলো CP(I)M, কীভাবে?
ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় অত্যন্ত জনপ্রিয় মুখ হয়ে উঠেছেন তিনি। অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীরা তাঁকে কুর্ণিশ জানিয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। মধ্যবিত্ত মানুষ যখন দশটা-পাঁচটা অফিস, অসাধ্য সাধ পূরণের লক্ষ্যে উদ্দেশ্যহীনভাবে ছুটে চলেছে,তখন তাঁর বিপরীত স্রোতে হেঁটে এক বাঙালি জীবনের আসল সত্য খুঁজে পেতে ছুটে চলেছেন ক্লান্তিহীন পথে। এর নামই হয়তো বেঁচে থাকা।
আনন্দ সিনেমার সংলাপ টা মনে আছে,” জিন্দেগী লম্বি নেহি/ বড়ি হোনা চাহিয়ে”- পরিমল কাঞ্জির মত মানুষেরা হয়তো এই জীবন দর্শনেই বিশ্বাসী। তাই আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকলেও পাগলামি থেমে থাকবে না। ছেলেকে দোকানে বসিয়ে তিনি চলেছেন ভারত ভ্রমণে। তাঁর এই ইচ্ছাকে সাধারণ মানুষ কুর্নিস জানিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়েছেন।
রায়গঞ্জে দাঁড়িয়ে পরিমলবাবু হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ার ট্রেকার্স এসোসিয়েশনের সদস্যদের আপন করে নিলেন। তিনি জানালেন রায়গঞ্জ আর কলকাতা দূর হলেও রাজ্যটা পশ্চিমবঙ্গ। ভিন রাজ্য থেকে ফিরে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে পা রাখতেই মনের ভেতর নতুন করে শক্তি সঞ্চার হয়। তাই এই মানুষগুলো তাঁর খুবই কাছের এবং আপন। কথা বলতে বলতেই সকলকে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানিয়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে সাইকেলের প্যাডেলে পা দিয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন।