দেশে সমলিঙ্গ বিবাহ নিয়ে এবার রায় ঘোষনা করল শীর্ষ আদালত। বুধবার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চে এই মামলার শুনানি হয়েছে। শুনানি চলাকালীন সমলিঙ্গ বিবাহের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে আপত্তি জানিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্রের যুক্তি, এক্ষেত্রে বিল পাস করে আইন আনতে পারে সংসদ। কিন্তু কোর্টের হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। এর আগে ২০১৮ সালে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারাকে অসংবিধানিক ঘোষণা করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। এর মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল সহমতের ভিত্তিতে সমকামীদের সহবাসকে।
আরও পড়ুন: ভারতের অগ্রগতিতে পাশে থাকার জন্য গুগুলের সিইওকে ধন্যবাদ মোদীর
প্রধান বিচারপতি বললেন, আদালত আইন তৈরি করতে পারে, আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারে। বিশেষ বিবাহ আইন পরিবর্তন করা সংসদের কাজ। অর্থাৎ, সুপ্রিম কোর্টে বৈধতা পেল না সমলিঙ্গ বিবাহ। এই ক্ষেত্রে আইন প্রনয়নের যাবতীয় দায় সংসদের দিকে ঠেলল আদালত। তবে, সমকামী দম্পতিদের লিভ ইন সম্পর্কে আইনি রক্ষাকবচ দিল সুপ্রিম কোর্ট।
বিচারপতি নরসীমাও জানালেন, তিনি বিচারপতি রবীন্দ্র ভাটের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, “বিবাহের অধিকার একটি বিধিবদ্ধ অধিকার। বিচারপতি ভাট জানিয়েছেন, কী কারণে বিশেষ বিবাহ আইন এবং বিদেশী বিবাহ আইনকে সাংবিধানিকভাবে চ্যালেঞ্জ করতে ব্যর্থ হয়েছে আবেদনকারীরা।” বিচারপতি ভাটের রায়কে সমর্থন করলেন বিচারপতি হিমা কোহলি৷
বিচারপতি রবীন্দ্র ভাটের রায় – ক. ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের বিয়ের অধিকারের বিষয়ে আমরা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে একমত। আমরা দত্তক নেওয়ার দিকটি নিয়ে একমত নই। প্রায়ই দেখা যায়, অবিবাহিত বা সমকামী দম্পতিরা তাঁদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হন। এই অবস্থায় তাঁরা বাবা-মা হতেই পারেন। কিন্তু, ধারা ৫৭-য় বলা হয়েছে, শিশুদের কাছে সমস্ত সুবিধা পৌঁছনো নিশ্চিত করতে স্থিতিশীল বাড়ির প্রয়োজন। খ. রাষ্ট্রের উপর একটি অত্যধিক বাধ্যবাধকতা তৈরি করা আইনশাস্ত্রের কাজ নয়। কিন্তু সমকামী মানুষদের নির্বিঘ্নে সহবাস করার অধিকার রয়েছে। কোনও হুমকি ছাড়া বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। গ. প্রশ্নগুলির প্রকৃতি যদি বহুকেন্দ্রিক হয়, তবে আদালতের তা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দিকে ঠেলে দেওয়া উচিত। যদিও আমরা এই আবেদনের প্রতি সহানুভূতিশীল, তবে তা পাওয়ার উপায়গুলি আইনগতভাবে সঠিক হতে হবে। ঘ. নাগরিক বিবাহকে আইনি মর্যাদা প্রদান করা শুধুমাত্র প্রণীত আইনের মাধ্যমেই হতে পারে। কিন্তু এই রায় সম্পর্কে থাকা সমকামী ব্যক্তিদের অধিকারে বাধা দেবে না। তবে, বিশেষ বিবাহ আইনে সমকামী শ্রেণির কথা নেই, এই ভিত্তিতে এই আইনকে চ্যালেঞ্জ করা যায় না।
তবে, বিচারপতি রবীন্দ্র ভাট জানালেন, তাঁর মত আলাদা। তাঁর পক্ষে মত রয়েছে বিচারপতি নরসীমা এবং বিচারপতি হিম কোহলির। বিচারপতি রবীন্দ্র ভাট বললেন, “সমকাম শহুরে বা অভিজাত বিষয় নয় এই বিষয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আমি সহমত। তবে, আমি তাঁর জারি করা নির্দেশের সঙ্গে একমত নই।” প্রধান বিচারপতির রায়ের সঙ্গে তিনি সহমত বলে জানালেন বিচারপতি এসকে কওল। তিনি বললেন, “সমলিঙ্গ সম্পর্ক প্রাচীনকাল থেকেই স্বীকৃত। শুধুমাত্র যৌন ক্রিয়ার জন্য নয় বরং মানসিক পরিতৃপ্তির সম্পর্ক হিসেবেও এটি স্বীকৃত।”
ভারত সরকারকে প্রধান বিচারপতির আদেশ – ক. সমকামী বিবাহে ব্যক্তিদের অধিকার নির্ধারণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে একটি কমিটি গঠন করতে হবে। খ. রেশন কার্ডে সমকামী দম্পতিদের পরিবার হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা, সমকামী দম্পতিদের যৌথ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা, পেনশনের অধিকার, গ্র্যাচুইটি ইত্যাদি বিষয়গুলি বিবেচনা করবে এই কমিটি।
প্রধান বিচারপতির রায় – ক. এই আদালতের এই মামলার শুনানির ক্ষমতা রয়েছে খ. সমকামী প্রাকৃতিক বিষয়, যুগ যুগ ধরে ভারতে হয়ে এসেছে। এটা কোনও শহুরে বা অভিজাত বিষয় নয়। গ. বিবাহ কোনও স্থির বিষয় নয়। ঘ. প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার কারণে এই আদালত বিশেষ বিবাহ আইন বাতিল করতে পারে না বা এই আইনে কোনও শব্দ যোগ করতে পারে না। আদালত উত্তরাধিকার আইনের মতো সংশ্লিষ্ট আইনের শব্দও বদলাতে পারে না। কারণ এটা আইন প্রণয়নের বিষয়।ঙ. সমকামী দম্পতিদের তাদের একগুচ্ছ অধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা বৈষম্যের সমান।চ. যৌন ইচ্ছার ভিত্তিতে দুই ব্যক্তির বিবাহের অধিকার আটকানো যায় না।ছ. বিদ্যমান আইনের অধীনে কোনও ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির কোনও অ-সমকামী ব্যক্তিকে বিবাহ করার অধিকার রয়েছে।জ. সমকামী সম্প্রদায়ের বিবাহের অধিকারের বিরুদ্ধে বৈষম্য করা উচিত নয় কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির।ঝ. সমকামী দম্পতিরা-সহ সকল অবিবাহিত দম্পতিরা যৌথভাবে সন্তান দত্তক নিতে পারেন।
সমকামী সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্য দূর করতে কেন্দ্র, রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির প্রতি বেশ কিছু নির্দেশনা জারি করলেন প্রধান বিচারপতি। এই মামলার বিষয়ে স্প্লিট ভার্ডিক্ট অর্থাৎ বিভক্ত রায় হয়েছে বলে জানালেন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়। তিনি জানালেন, বিচারপতি রবীন্দ্র ভাটের রায়ের সঙ্গে তাঁর দ্বিমত রয়েছে। প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়, বিচারপতি এস কে কওল, বিচারপতি রবীন্দ্র ভাট এবং বিচারপতি নরসীমা চারটি পৃথক রায় দেবেন।