সূর্য সেনের স্ত্রী পুস্প-এর কঠিন আত্মত্যাগ. বিয়ের রাতে মাস্টারদা এসেছেন বিয়ে করতে। বিয়ের মন্ত্র পড়া শুরু হবে, ঠিক এমন সময় হঠাৎ পাশ থেকে একজন মাস্টারদার হাতে গুজে দিলো একটা চিরকুট। চিরকুট পড়ে চিন্তিত ও গম্ভীর হয়ে গেলেন মাস্টারদা। গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ এসেছে কলকাতার দলের উচ্চমহল থেকে। দুদিন পরে ফুলশয্যার রাতে নির্জন কক্ষে সহধর্মিনী পুষ্প কে বললেন, ” তোমার কাছে আমার অপরাধের সীমা নেই। তুমি আমার অগ্নিসাক্ষী করা স্ত্রী। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তুমি আমার স্ত্রীই থাকবে। কিন্তু দলের গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমার ডাক এসেছে। তোমার কাছ থেকে আমাকে বিদায় নিতে হবে।
অশ্রুসিক্ত নয়নে মাষ্টারদাকে বিদায় দিয়েছিলেন নব বিবাহিতা স্ত্রী। শুধু জিজ্ঞেস করেছিলেন, মাষ্টারদার চিঠি পাবে কি-না ? কথা রেখেছিলেন মাস্টারদা চিঠি আসত পুষ্পর কাছে তবে খুবই গোপনে।
সেই চিঠি শুরু হতো, “স্নেহের পুষ্পা দিয়ে,” আর শেষ হত,
” তোমারই সূর্য দিয়ে।”
কিন্তু আর কোনদিন কি দেখা হয়নী স্বামী-স্ত্রী ?
হ্যাঁ, হয়েছিল, পুষ্প যখন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত, মৃত্যুপথযাত্রী সূর্য তখন জেলে। একদিনের প্যারোলে কয়েক ঘণ্টার জন্য ছাড়া পেয়ে স্নেহের পুষ্প কে দেখতে এসেছিলেন মাস্টারদা। কিন্তু তার আগেই ২-রা ফেব্রুয়ারি ১৯৩৩ সালে জীবনদীপ নিভে গিয়েছিল পুষ্পর।
কি ভাবে ধরা পড়েছিলেন মাস্টারদা ?
সূর্যসেন তখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। পলাতক সূর্যসেনকে গৈরালা গ্রামে নিয়ে এসেছেন ,বিপ্লবী ব্রজেন সেন। মাস্টারদার সঙ্গে রয়েছেন তাঁর একান্ত অনুগত শান্তি, কল্পনা দত্ত, সুশীল ও মনি দত্ত। ওই সময় তাঁরা ছিলেন গ্রামের বিশ্বাস বাড়িতে। পরম যত্নে আগলে রেখেছিলেন সেই বাড়ির বড় বধু ক্ষিরোদপ্রভা। কিন্তু বিপদ এলো অন্য দিক দিয়ে। প্রতিবেশী নেত্র সেনের সন্দেহ হলো। কারা আছে বিশ্বাস বাড়িতে ? কিসের এত সাবধানতা ? কিসের এত ফিসফাস গুঞ্জন ? খবর নিতে পাঠালেন নিজের স্ত্রী-কে। গ্রাম্য বধূটি সরল মনে দেখে এসে বলল, ওই বাড়িতে সূর্যসেন লুকিয়ে আছে গো, অমন লোককে খাওয়ালেও যে পুণ্যি লাভ হয়। শুনেই লাফ দিয়ে উঠলো নেত্র সেন, পুলিশে খবর দিলে কড়কড়ে ১০ হাজার টাকা। বউকে আশ্বস্ত করে ব্যগ হাতে বেরিয়ে পড়ল। সোজা গিয়ে উঠল থানায়।
সেদিন রাতেই ছোটভাই ব্রজেন সেন দেখল, জালনা দিয়ে লন্ঠন দেখিয়ে কিছু একটা ইশারা করছে , দাদা নেত্র সেন। বুঝতে একটুও দেরি হলো না ভাইয়ের। ছুট লাগালো বিশ্বাস বাড়ির দিকে, কিন্তু ততক্ষনে বেশ দেরি হয়ে গেছে। ক্যাপ্টেন ওয়ামসলের নেতৃত্বে বিশ্বাস বাড়ি ঘিরে ফেলেছে গোর্খা সেনার দল। পরদিন দেশের সমস্ত সংবাদপত্রের হেডলাইন ছিল
“গৈরালা নামক গ্রাম থেকে সূর্যসেন গ্রেপ্তার। সূর্য সেনকে ধরার জন্য সরকার দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করিয়াছিলেন।” অমৃতবাজার পত্রিকা ১৭, ২, ১৯৩৩ প্রকাশিত মতে।
ওই সময় দশ হাজার টাকার মূল্য বড় একটা কম ছিলনা। যখন বড় বড় সরকারি আমলারা ৬০ টাকা বেতন পেতেন।
নেত্র সেনের শাস্তি :
পুরস্কারের টাকা কিন্তু নেত্র সেনের পাওয়া হলো না। সেদিন সন্ধ্যেবেলায় জল খাবার খেতে বসেছে নেত্র সেন, পাশে স্ত্রী। দরজায় শব্দ হতে উঠে গিয়ে খুলে দিলেন নেত্র সেনের স্ত্রী ।
একটি ছেলে ভোজালি হাতে প্রবেশ করল নেত্র সেনের ঘরে। নেত্র সেনের স্ত্রী কোন বাধা দিলেন না। চোখের পলকে সেই ছেলেটির হাতের ভোজালির এক কোপে স্বামীর মুন্ডু ছিটকে পড়ল। চলে যাওয়ার আগে ছেলেটি বলে গেলেন, ” মাস্টারদার সঙ্গে বেইমানি করার এটাই উপযুক্ত শাস্তি।”
ব্রিটিশ পুলিশ বহুবার বিভিন্নভাবে জেরা করেছিল ওই সাধারণ গৃহবধুটিকে, তার স্বামীর হত্যাকারীর নাম জানার জন্য। কিন্তু কোনোভাবেই মুখ খোলেনি নেত্র সেনের বিধবা। শুধু একটাই কথা তার মুখে, ” চোখের সামনে তিনি স্বামীকে লুটিয়ে পড়তে দেখে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছিলেন, আততায়ীর মুখ দেখতে পারেনি। স্বামী হারানোর যন্ত্রণায় এখন কষ্ট পাচ্ছেন, আর কিছু বলার নেই।
বাস্তবে তিনি বেশি মানসিক কষ্ট পেয়েছিলেন এই ভেবে যে, তার স্বামী নেত্র সেন, একজন বিশ্বাসঘাতক। পুলিশের পুরষ্কারের লোভে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন মাস্টারদার মত দেশপ্রেমিকের সঙ্গে। তাই তিনি মনে করতেন তার স্বামীকে হত্যা করে ঠিক কাজ করেছেন, মাস্টারদার সহযোগী ওই যুবক। তাই কোন অবস্থাতেই তিনিও এই বিপ্লবীর নাম বলতে রাজি নয়।
অনেকদিন পরে জানা গিয়েছিল যে, নেত্র সেনের হত্যাকারী আর কেউ নয়, সেন বংশের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ওই বাড়ির ছোট ছেলে কিরণ সেন। মাস্টারদা মরার আগে জেনে গিয়েছিলেন দেশদ্রোহী কে চরম দণ্ড দেওয়া তার মন্ত্র শিষ্যের নাম। এবার শুনুন জেলের ভিতর মাস্টারদার সঙ্গে কি নিদারুণ অত্যাচার করা হয়েছিল।
পিটিয়ে শরীরের সমস্ত হাড় ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল তাঁর সব দাঁত। উপড়ে ফেলা হয়েছিল হাত ও পায়ের সমস্ত নখ। মাস্টারদার সঙ্গে এমনই বর্বর আচরণ করেছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। অবশেষে ১৯৩৪ সালের ১২ ই জানুয়ারি মাস্টারদাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ভুল বললাম মাস্টারদাকে নয় তাঁর মৃতদেহকে। সূর্য সেনের
আরও পড়ুন – পৌরসভার উদ্যোগে স্বামী বিবেকানন্দের পূর্ণাঙ্গ মূর্তি স্থাপন
এমনকি মৃত্যুর পরে তার দেহ তুলে দেওয়া হয়নি পরিজনদের হাতে। ছুড়ে ফেলা হয়েছিল সমুদ্রের বুকে। ঠিক যেভাবে আমরা ছুঁড়ে ফেলি কোন আবর্জনাকে ডাস্টবিনে ঠিক সেভাবেই।
প্রতিবছর ১২ ই জানুয়ারি ঘটা করে বিবেকানন্দের জন্ম দিন পালন করুন ক্ষতি নেই। কিন্তু একবার হলেও এই মহান বিপ্লবীর জন্য এক মিনিট হলেও মৌনব্রত পালন করুন। অন্তরের শ্রদ্ধা এবং লক্ষ কোটি প্রণাম জানাই এই মহান বিপ্লবীরকে। সূর্য সেনের