কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা থেকে আজকের গঙ্গাসাগর ও মুখ্যমন্ত্রীর অবদান । বুধবার গঙ্গাসাগরে আসবেন মুখ্যমন্ত্রী। তাই মঙ্গলবার সাংবাদিকদের নিয়ে আসার পরিকল্পনা করে প্রশাসন। দুরের রাস্তা। তার মাঝে নদী পারাপারের ঝক্কি। প্রেস সেক্রেটারি প্রদীপ কুমার চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সাংবাদিক বন্ধুরা খুব সকালে গিয়ে হাজির কলকাতা প্রেস ক্লাবে। আমি একটু পিছিয়ে ছিলাম তবে নটার আগেই পৌঁছনোর কড়া নির্দেশ দিলেন প্রদীপ। অক্ষরে অক্ষরে পালন করে ৮টা ৫৪তে পৌঁছলাম।
ঠিক ৯টা ১৫তে বাস ছাড়ল। পরপর তিনটি লাক্সারী বাসভর্তি সাংবাদিকরা শুভযাত্রা করলেন পবিত্র গঙ্গাসাগরের উদ্দেশ্যে। পুরাণে কথিতমতে ভক্ত সাধক ভগীরথ তার পূর্ব পুরুষ সগর বংশের ষাট সহস্র পুত্রদের উদ্ধার করতে গঙ্গাকে আনয়ন করেছিলেন এখানে। তিনি কঠোর তপস্যায় প্রথমে গঙ্গাকে সন্তুষ্ট করেন এবং গঙ্গাকে সাগরে মিলিত হতে রাজী করান। পরে মহাদেবকে সাধনায় তুষ্ট করে গঙ্গাকে তার জটায় ধারণ করতে রাজী করিয়াছিলেন। ভগবান শিবের তিন জটায় ত্রিধারা় হয়ে পৃথিবীতে পতিত হন গঙ্গা । এভাবেই মা গঙ্গাকে গঙ্গাসাগরে আনেন ভগীরথ।
সেই থেকে এই তীর্থের নাম হয় গঙ্গাসাগর যেখানে গঙ্গার সঙ্সগে সাগরের সঙ্গম সাধিত হয়। সেই থেকেই গঙ্গাসাগর অতি পবিত্র স্থান হিসাবে সুপরিচিত। আর আমরা ভাগ্যবান যে এই স্থানটি আমাদের রাজ্যে অবস্থিত। শোনা যায় রাবণ পুত্র জীবন বাঁচানোর জন্য এখানে এই পাতালে এসে লুকিয়েছিলেন। তাই গঙ্গাসাগরকে মহাভারত গ্রন্থে ‘পাতাল’ বলা অভিহিত করা হয়েছে। হিমালয়ের সঙ্গে তুলনা করলে গঙ্গাসাগর খুব নীচুতে অবস্থিত ।
সগরবংশের পৌরাণিক কাহিনীর সঙ্গে জড়িত মহাতেজী মহাসাধক কপিলমুনির অনেক অলৌকিক জনপ্রিয় কাহিনী। তাই কপিলমুনির আশ্রমরুপেও গঙ্গাসাগর পৃথিবীতে প্রসিদ্ধিলাভ করেছে। কপিলমুনির অভিশাপেই অতি অহঙ্কারি সগরবংশের ধ্বংস আবার তার আশীর্বাদে সগরবংশের মুক্তিলাভ। তাই সব তীর্থ বারবার গঙ্গাসাগর একবার। এহেন পুণ্যস্থানের মাহাত্ম্য, পৌরাণিক ইতিহাস ও তার পাপ বিনাশী ক্ষমতা যুগে যুগে টেনে এনেছে মানুষকে এই পুণ্যভূমিতে। বিদেশীরাও আসেন গবেষণা করতে যে, কি কারণে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ আসেন এই তটভূমিতে। কি তাদের প্রাপ্তী। কি তাদের আকাঙ্খা পূরতী।
যদিও আমাদের আসার কারণ মুখ্যমন্ত্রীর সাগর সফর। কেন এই সফর জানতে পারব বুধবার। পূজো দেবেন ও ভারত সেবাশ্রম দর্শন করবেন যা নিশ্চিত করে জানা গেছে। বাকিটা অজানা।আগেরদিন মিডিয়াকে নিয়ে আসা এবং বৃহস্পতিবার ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ আছে। আর তার এই কর্মসূচীর কথা জানালেনপ্রদীপবাবু। আশাকরি আগামীরসবসূচী তিনি আমাদের জানাবেন। যাহোক কলকাতা প্রেস ক্লাব থেকে বাস ছাড়ার পরেই সবার হাতে একটি সুবৃহৎ খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দেওয়া হল। আমার পক্ষে এই পরিমাণ অনেকটাই বেশী। তায় আবার সকালে।
দুই ঘন্টার মধ্যেই ডায়মন্ডহারবারের ‘শুভম’ সরকারি দপ্তরে চা, কফি, পকোড়া দিয়ে স্বাগত জানানো হল মিডিয়ার বন্ধুদের। আমি তিরিশ টাকা দিয়ে একটি সবুজ ডাব নারকেল কিনে খেলাম। শুধু ডাব বললে এখন বুঝতে পারেন না। সিনেমার ‘ডাবিংয়ের’ কথা মনে পড়ে যেতে পারে। ততক্ষণে বাকি বন্ধুরা সেলফি ফটোশূট করতে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। অনেকেই এসেছেন যারা প্রথমবার এই পথের দিকে পা বাড়িয়েছেন।
আমার কাছে এসব পুরনো হলেও প্রতিবছর নতুন করে উপভোগ করি। শান্তসমির আনন্দের নীড় বলতে যা বোঝায় তা কখনোই ছিল না এই পরিক্রমণ। তবে আজ তা সহজতর হয়েছে। শুভম ছেড়ে আবার বাসে চড়া। চড়াই নেই কিন্ত ভাটায় চর পড়ে গেলে ভেসেলে পারাপারের সমস্যা হবে নাতো ! সরকারের আধিকারিক বললেন না। ড্রেজিং হয়েছে। ভয়ের কোন কারণ নেই। কাশ্মীরের মোড় দিয়ে এক মোচড়ে বাস ঢুকে পড়ল লট নম্বর এইট বা হারউড পয়েন্টের দিকে। ভেসেল দাড়িয়ে আমাদের জন্য। জলযান মোটরলঞ্চ কয়েকটি আছে তারাও পারাপারের দায়িত্বে।
আধঘন্টার ওপর ধরে মুড়িগঙ্গার বুকে ভাসতে ভাসতে মাতৃ কোল থেকে নেমে আসার মত করে আমরা নামলাম এপারে কচুবেড়িয়া। ওপারে আট নং লট আর এপারে কচুবেড়িয়া। এপারে আসতেই ‘মিও মোরের’ পাকেট হাতে ধরিয়ে দিলেন সরকারি তথ্য দপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মীরা। যেন এরা সব যান্ত্রিক সভ্যতার রোবটিক নিখুঁত কাজের পরীক্ষা দিচ্ছেন। বড্ড বেশী হয়ে গেল খাবারের প্যাকেটের বোঝা। কিন্ত এত সুন্দর মসৃণ ছিল এদের কাজ যে মাঝে কোন বাক্য নি:সরণের সুযোগ ছিল না। কচুবেড়িয়া থেকে যথারীতি তিনটি লাক্সারী বাসে আমরা চাপলাম।
বাবস্থাপণা ছিল এতটাই উন্নত যে আমাদের সময়টা কখন অপরাহ্নের দিকে ঢলে পড়েছিল মালুম হয়নি। বাকরহিত এক জার্নি শেষে লটবহরসহ শরীরের ভারটা নামিয়ে রাখলাম সাদা ধবধবে মখমলের মত বিছানায়। তার মধ্যেই লাঞ্চ ডাক এল। এটিকে ‘লেট লাঞ্চ’ বলা ভাল। মাঝের পাতুড়ি গলদা চিংড়ির মালাইকারি শেষে চাটনি। শেষ কবে কোন বিয়ে বাড়িতে এমন খেয়েছি মনে করতে পারলাম না। চেটেপুটে খাবার খেলাম সকলে।
আরও পড়ুন – দলকে চাঙ্গা করতে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে মালদহে এনে চমক দিতে চাইছেন কংগ্রেস
সন্ধ্যা হতে না হতেই আবার চা কফি খাবার ডাক পড়ল কান্টিন থেকে। সঙ্গে ছিল মাংসের কাবাব, কর্ণ-এর পকোড়া। এর মধ্যে আরো দুতিনবার চা কফির ডাক এসেছে। অনেকেই হে ডাকে সাড়া দিচ্ছেন। আর আমি আজকের এই যাত্রার পালা লেখার লোভ সংবরণ করতে না পেরে লিখতে বসলাম। লিখেও ফেললাম রোজনামচার মত করে। কেউ যেন আবার চামচা বলবেন না।
আর একবার প্রদীপ চক্রবর্তী ও প্রশাসনকে সালাম জানালাম। পরম পবিত্র সাগরসঙ্গমের পুণ্যতোয়া স্পর্শ করে আর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগমনের প্রতীক্ষায় থেকে ডিনারের তোড়জোড়ে লেগে পড়লাম আমরা। রুচিশীল মননের এক পরিশিলিত রূপ দেহমনের ক্লান্তি দুর করে অনুভুতির বৈভবে উত্তরণ করে গা এলিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি। সর্ব মঙ্গল: মঙ্গল্যে, শিবে সর্বার্থ সাধিকে। শরণ্যত্রম্বকে গৌরী নারায়ণী নমোহস্তুতে।”