পাকিস্তানের রাজনীতিতে ‘অদৃশ্য শক্তি’ আসলে কে? কাদের কলকাঠি নাড়াতে বদলে যায় দৃশ্যপট। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অপেক্ষাকৃত সাফল্য দেখিয়েও ইমরান খান শেষ পর্যন্ত নিজের মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। শনিবার পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে তার বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটিতে হেরে যান তিনি। সেইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয় তাকে। ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পার্লামেন্টের ৩৪২ আইনপ্রণেতার মধ্যে ১৭২ ভোটের প্রয়োজন ছিলো। সেখানে তার বিরুদ্ধে ভোট পড়েছে ১৭৪টি।
সূত্র জানায়, পার্লামেন্টে ভোটাভুটির অধিবেশন চলাকালেই ইমরান খান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ত্যাগ করেছিলেন। পদত্যাগ করেছেন স্পিকার আসাদ কায়সারও। এখন আছেন কোথায় ইমরান খান? তিনি পাকিস্তানের যেখানেই থাকুন না কেনো সামনে তার জন্য অপেক্ষা করছে এক কণ্টকময় বন্ধুর পথ। অনেক প্রশ্ন সামনে আসছে- ইমরান কি পাকিস্তানে থেকে তার স্বাভাবিক রাজনীতি চালিয়ে যেতে পারবেন, নাকি তাকে তার অনেক উত্তরসূরির মতো কারাবরণ বা নির্বাসনে যেতে হতে পারে? এর আগে যারা পাকিস্তানের সবচেয়ে অস্থিতিশীল (সম্ভবত) প্রধানমন্ত্রীর পদে বসেছিলেন, তাদের পরিণতি সুবিধাজনক ছিল না।
কেউ কেউ জীবনের মূল্য দিয়ে শোধ করেছেন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দায়; কেউ কেউ পালিয়ে গেছেন বিদেশে; কেউবা কারাগারে পার করেছেন দুর্বিসহ দিন। শুরুটা করা যাক শুরু দিয়ে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর দেশটির প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম লিয়াকত আলী খান প্রথমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পরে প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৫১ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে তিনি ভাড়াটে খুনি সাইদ আকবরের হাতে নিহত হন। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। পাকিস্তান পিপলস পার্টির এ প্রতিষ্ঠাতা নেতার পরিণতিও হয়েছিল নির্মম।
সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ১৯৭৯ সালে বিরোধী রাজনীতিককে হত্যার নির্দেশ দেয়ার অভিযোগে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। রাজনীতিতে চরম পরিণতি দেখেছেন তার কন্যা বেনজির ভুট্টোও। পাকিস্তানের প্রথম এ নারী প্রধানমন্ত্রীকে ২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডির একটি রাজনৈতিক র্যালিতে গুলি ও আত্মঘাতি হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয়। ওই হামলায় আরও ২৩ জনের প্রাণ গিয়েছিল। পাকিস্তানের রাজনীতিতে হত্যার ইতিহাস যেমন সাধারণ, তেমনি কারাবরণ এবং নির্বাসনও দেখা যায় অহরহ।
দেশটির সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিক ছিলেন নওয়াজ শরিফ। তিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু তাকে নির্বাসন ও কারাবাসে কাটাতে হয়েছে এক দশকেরও বেশি সময়। পানামা পেপার্সে দুর্নীতির খবর ফাঁস হওয়ার পর ২০১৭ সালে ক্ষমতা হারান তিনি। সামরিক বাহিনীর প্রধান থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন পারভেজ মুশাররফ। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট তিনি পদত্যাগ করেন। তার পদত্যাগের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন ৬৩ শতাংশ পাকিস্তানি; নাখোশ হয়েছিলেন মাত্র ১৫ শতাংশ। ওই বছরের ২৩ নভেম্বর লন্ডনের উদ্দেশে তিনি দেশ ছাড়েন।
আরও পড়ুন – ‘যেসব নেতারা অস্বস্তি ঘটাচ্ছে তাদের ছেঁটে ফেলার প্রক্রিয়া কি শুরু হল?’ তৃনমূলকে খোঁচা তথাগতের
এখন ফেরা যাক ইমরান খানের প্রসঙ্গে। ইমরান খানকে একটু দূর থেকে দেখলে পাকিস্তানের সবচেয়ে ব্যতিক্রম মেজাজের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখা যায়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদে থেকে মেয়াদ পূর্ণ করেছেন, এমন কোনো রেকর্ড নেই। ইমরানের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ইমরান ব্যতিক্রম ছিলেন। কারণ, তিনি পাকিস্তানের অন্য প্রধানমন্ত্রীদের মতো যুক্তরাষ্ট্রপন্থী ছিলেন না। তার পররাষ্ট্রনীতি ঝুঁকে ছিল রাশিয়ার দিকে।
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘে যে প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল, সে প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়া থেকেও বিরত ছিল তার সরকার। ইমরান পাকিস্তানের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের পররাষ্ট্রনীতির প্রশংসা করেছিলেন। এটা ছিল খুবই ব্যতিক্রম একটি ঘটনা। কারণ, পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রীর মুখে ভারতের প্রশংসা খুব কমই শোনা যায়। এ নিয়ে পার্লামেন্টে সমালোচনারও মুখে পড়েছিলেন ইমরান। সব মিলিয়ে পাকিস্তানের ভারতবিরোধী মনোভাব সম্পূর্ণই ইমরানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রপন্থী সত্ত্বাগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ইমরান খানের সামনে তার কঠিন বিপদ। এ কারণে স্বাভাবিকভাবে যে তিনি মুক্ত থেকে রাজনীতি করে যেতে পারবেন, সে নিশ্চয়তা দেয়া যাচ্ছে না।