গান্ধীজির সাথে নেতাজির চিন্তাধারার মতবিরোধ

চিন্তাধারার

গান্ধীজির সাথে নেতাজির চিন্তাধারার মতবিরোধ। ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে স্মরণীয় বছর ছিল ১৯৩৮ সাল। ঐ বছর নেতাজি কংগ্রেস সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং ৪১ বছরে কংগ্রেসের প্রথম বিদ্রোহী সভাপতি হিসেবে। নিজের কৃতিত্ব দ্বারা তখন তার জনপ্রিয়তা প্রচুর, কোন কোন স্থানে নেতাজির জনপ্রিয়তা এতটাই বেশি ছিলো যে সেখানে গান্ধীজির খ্যাতিকেও ম্লান করে দিয়েছিল। ১৯২১ সাল থেকে নেতাজি কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। একাধিকবার নেতাজির বিরোধ বেঁধেছিল গান্ধীজি সহ তার ডানপন্থী নেতাদের সঙ্গে। গান্ধীজির অহিংসা নীতির সারমর্ম নেতাজি কখনোই বুঝতে পারেননি।

 

১৯২৮ সালে নেতাজি নির্বাচনী কমিটির অধিবেশনে প্রকাশ্যে বলেন- “আমাদের ইতিহাসের গভীর সংকট ক্ষণে আমাদের বর্ষিয়ান নেতারা সঠিক সময়ে উপযুক্ত নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছেন, সেটা আমি বিশেষভাবে উপলব্ধি করেছি”। ১৯৩৭ সালে গান্ধীজি মাত্র সাতটি প্রদেশে কংগ্রেসি মন্ত্রিসভা পান। তার ফলে লুপ্ত হতে বসা তার নেতৃত্ব বেশ কিছুটা পুনরুদ্ধার হয়। ঐ সময় গান্ধীজি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয় এবং এটাও বুঝেছিলেন তরুণ ও তার বামপন্থী সদস্যদের মধ্যে নেতাজির প্রভাব সুস্পষ্ট। এছাড়াও ভারতের একটি বৃহৎ অংশের মানুষ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের নেতৃত্ব কামনা করছে তাও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। হরিপুরা কংগ্রেসের ৫১ তম অধিবেশনে সভাপতি হলেন সুভাষচন্দ্র বসু।

 

এটা ছিল নেতাজির প্রকৃত রাজনৈতিক অভিষেক, কারণ সেই দিন এই নবীন নেতা কে অভিনন্দন জানানোর জন্য পথের দুই ধারে অগুনতি জনতা দাঁড়িয়ে ছিল। রাজেন্দ্র প্রসাদ তার আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন,- “হরিপুরা কংগ্রেসের অনুষ্ঠানে সুভাষচন্দ্র বসুর সভাপতিত্বে মানুষের অভূতপূর্ণ উদ্দীপনা দেখা গিয়েছিল তার কারণ একমাত্র স্বয়ং সুভাষচন্দ্র বসু”। কংগ্রেসের নতুন সভাপতিকে ভারত সরকার খুশি মনে গ্রহণ করতে পারেনি তার কারণ সুভাষচন্দ্র বোস ছিলেন তাদের শাসনতন্ত্রের প্রবল বিরোধী।

 

সুভাষচন্দ্র বসুর চিন্তা ধারা ছিল কংগ্রেসের পুরনো কাঠামোকে ভেঙে নবীন রূপে গড়ে তোলার। ঠিক সেই কারণেই ঝড়ের বেগে তিনি ভারতের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পরিদর্শন করে মানবজাতির অন্তরে সঞ্চার করেছিলেন নতুন উদ্দীপনা। তিনি জাতিভেদ নির্বিশেষে কৃষক, মজু্‌ বামপন্থী এবং আরো সকল স্তরের কর্মীকে একসঙ্গে কংগ্রেসের পতাকাতলে সমবেত হতে বলেন। আশ্চর্যকর বিষয় হলো তিনি এই শক্তি নিয়েই সকলকে সংগ্রাম শালী হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। এই ঘটনায় ইংরেজদের মনে ত্রাসের সৃষ্টি হয় এবং সাথে গান্ধীজি ও অন্যান্য ডানপন্থী নেতারা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন।

 

কারণ সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তরে গান্ধীজি বৈপ্লবিক চিন্তাধারাকে অহিংসার শান্তির জল ছিটিয়ে নিভিয়ে দিতে পারবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি, দিনে দিনে গান্ধীজি ও সুভাষচন্দ্র বসুর মধ্যে ঐক্য ভাঙতে শুরু করে। ১৯৩৯ সালে সুভাষচন্দ্র বসু উপলব্ধি করলেন ইউরোপে যুদ্ধ নিশ্চিত। ইংল্যান্ডের বিপদ, আর ভারতের সুবর্ণ সুযোগ। এই সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য সুভাষচন্দ্র বসু ভারতবাসীকে আহ্বান করেন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে। কিন্তু গান্ধীজি এই সুযোগ কখনোই গ্রহণ করলেন না। কংগ্রেসের অন্যান্য সদস্যরা যুক্ত রাষ্ট্রের শাসনের পক্ষে আপোষ করতে আগ্রহী ছিলেন। এই চরম সংকট জনক অবস্থায় সুভাষচন্দ্র বোস দ্বিতীয় বার কংগ্রেসের সভাপতি পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

 

আর ও পড়ুন    নেতাজির সঙ্গে কী হয়েছিল? সত্যিই কি তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় তিনি প্রয়াত হন?

 

জানা যায় গান্ধীজি এতে সমর্থন করেননি। গান্ধীজির নির্দেশে ওয়ার্কিং কমিটি সুভাষচন্দ্র কে দ্বিতীয়বারের জন্য মনোনয়নপত্র দিতে অসম্মতি প্রকাশ করে। গান্ধীজির ইচ্ছে ছিল মৌলানা আবুল কালাম আজাদ মহাশয় সভাপতি গ্রহণ করুক। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ যখন রাজি হলেন না তখন সর্দার প্যাটেল মাদ্রাজের অজ্ঞাতনামা কংগ্রেস কর্মী পট্টভি সীতারামাইয়ার নাম প্রস্তাব দেন। শেষ পর্যন্ত পট্টভি সীতারামাইয়া কে মনোনয়ন পত্র দেওয়া হয়। অবাক করার মতো ঘটনা ছিল এই নির্বাচন।

 

সিতারামাইয়া কে বিপুল ভোটে পরাজিত করে দ্বিতীয়বার কংগ্রেসের সভাপতিত্ব গ্রহণ করলেন সুভাষচন্দ্র বসু। গান্ধীজি সেদিন স্বীকার করেছিলেন এবং বলেছিলেন,- “সীতারামাইয়ার পরাজয় মানেই আমারই পরাজয়”। সুভাষচন্দ্র বসু একটি অনুষ্ঠানে অসুস্থ শরীর নিয়ে বক্তৃতা দেন,- “ক্ষমতার লোভে আমাদের মধ্যে যেমন দুর্নীতি ও দুর্বলতা এসেছে তেমনই নির্মমভাবে তার মূল্য ছেদ করার জন্য আমাদের উপায় নির্ধারণ করতে হবে”। সুভাষচন্দ্র গান্ধীজির বিরোধিতা করেছেন বলে কংগ্রেস দলের লৌহমানব সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল গান্ধীজির মর্যাদা রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন।

 

সেই ঘটনা কংগ্রেসের ইতিহাসে কলঙ্কিত অধ্যায়। সেই সময়ে শরৎ বসু গান্ধীজিকে একটি চিঠি লিখেছিলেন- “ত্রিপুরাতে যে সপ্তাহকাল আমি ছিলাম তখন যা দেখেছি এবং শুনেছি তাতে আমার চোখ খুলে গেছে। জনসাধারণ যাদের আপনার নির্বাচিত হলে জানে তাদের আচরণের মধ্যে সত্য ও অহিংসার যে পরিচয় পেয়েছি তা আপনার ভাষায় নাসারন্ধ্রের পক্ষে নক্কারজনক।

 

যখন তারা কংগ্রেসের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে যে ধরনের ব্যবহার করেছেন তা সম্পূর্ণভাবে হীন, বিদ্বেষপূর্ণ, এবং প্রতিহিংসার উদ্যোগী। এটা কোনভাবেই সত্য ও অহিংসার ধারে কাছেও যান না। খুবই দুঃখের এবং লজ্জার কথা এরা আপনারই অনুগত”। সেই সময় কংগ্রেসের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির সকল আলোচনা ব্যর্থ হলে সুভাষচন্দ্র বসু সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করলেন এবং গান্ধীজির নির্দেশে রাজেন্দ্র প্রসাদ বসলেন কংগ্রেসের গতিতে। এরপরই সুভাষচন্দ্র বসু গঠন করলেন ফরওয়ার্ড ব্লক দল।

 

কারণ সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তরে গান্ধীজি বৈপ্লবিক চিন্তাধারাকে অহিংসার শান্তির জল ছিটিয়ে নিভিয়ে দিতে পারবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি, দিনে দিনে গান্ধীজি ও সুভাষচন্দ্র বসুর মধ্যে ঐক্য ভাঙতে শুরু করে। ১৯৩৯ সালে সুভাষচন্দ্র বসু উপলব্ধি করলেন ইউরোপে যুদ্ধ নিশ্চিত। ইংল্যান্ডের বিপদ, আর ভারতের সুবর্ণ সুযোগ। এই সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য সুভাষচন্দ্র বসু ভারতবাসীকে আহ্বান করেন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে।