নেতাজির রাজনৈতিক চিন্তাধারা

রাজনৈতিক

নেতাজির রাজনৈতিক চিন্তাধারা। কার্যত নেহরুর পরিবর্তে সুভাষচন্দ্রই তখন হয়ে উঠেছিলেন ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে বামপন্থার অন্যতম প্রতীক। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন নতুন মোড় নিয়েছিল সুভাষচন্দ্রের দেশেফেরা এবং ১৯৩৭ সালে সাময়িক কারামুক্তির পর। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সাল, এই তিন বছর কাল ভারতবর্ষের জাতীয় রাজনীতি বাম-অভিমুখী হয়েছিল এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের শীর্ষে উপনীত হয়েছিল সুভাষচন্দ্র বসুকে কেন্দ্র করে। কার্যত নেহরুর পরিবর্তে সুভাষচন্দ্রই তখন হয়ে উঠেছিলেন ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে বামপন্থার অন্যতম প্রতীক।

 

কমিউনিস্ট পার্টিও এই পর্যায়ে সম্পূর্ণতই সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে ছিল এবং ১৯৩৯-১৯৪০ সালে ফরওয়ার্ড ব্লক গঠিত না হওয়া পর্যন্ত তারা সর্বদাই সুভাষচন্দ্রকে সমর্থন জুগিয়েছে। লেনার্ড গর্ডন তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, পক্ষান্তরে সুভাষচন্দ্রও কমিউনিস্টদের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতিতে উদগ্রীব ছিলেন। বসুর কংগ্রেস সভাপতিত্ব কালে সোমনাথ লাহিড়ী, বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়, গোপাল হালদার প্রমুখ কমিউনিস্ট নেতা তাঁর সঙ্গে নানা সময়ে সক্রিয় ভাবে কাজ করেছিলেন। তবে সুভাষচন্দ্র বসু তাত্ত্বিক ভাবে সে অর্থে সোশ্যালিস্ট ছিলেন না। জাতীয়বাদ, সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ এমনকী কিয়দংশে ফ্যাসিবাদের এক অদ্ভুত রাজনৈতিক সংমিশ্রণ সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক চিন্তাধারার ভিত্তি ছিল।

 

এই প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে অধ্যাপক হীরেন মুখোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণ হয়তো অনেকটাই সঠিক। লক্ষ্য সাধনই তাঁর কাছে মূল বিষয় ছিল, মত-পথ-তত্ত্ব ও আদর্শ নিয়ে সুভাষচন্দ্র সে ভাবে মাথা ঘামাননি। তবে তাৎপর্যময় বিষয় হল, ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৩৯ সালের ওই পর্বে সমগ্র দেশের আপামর বামপন্থী সোশ্যালিস্ট, কমিউনিস্ট সকলেরই রাজনৈতিক চেতনার আইকন বা প্রতীক হয়ে ওঠেন সুভাষচন্দ্র বসু। সুভাষচন্দ্র বসু গুজরাতের হরিপুরায় ১৯৩৮ সালের ১৯ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের ৫১তম অধিবেশনে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন তা বস্তুতই ছিল দেশের বামপন্থী শক্তির মনের কথা। সভাপতির ভাষণে সুভাষচন্দ্র স্বাধীনতার দাবিতে সক্রিয় প্রতিরোধের কথা তুললেন, যদিও তা হবে অহিংস।

 

মন্ত্রিত্ব গ্রহণ একটি সাময়িক পদক্ষেপ। বৃহত্তর সমস্যা হল ব্রিটিশদের ফেডারেশন চক্রান্ত এবং তা ঠেকাতে আরও বড়ো আইন অমান্য আন্দোলন করা।স্বাধীনতার পর ভারতের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো কী হবে তারও রূপরেখা দিলেন তিনি। এমনকী ভাবী স্বৈরতন্ত্রের প্রতিষেধক রূপে তিনি বহুদলের কথা বললেন, গণতান্ত্রিক ভিত্তিও মেনে নিলেন, জাতীয় পরিকল্পনার ওপর জোর দিলেন এবং দেশের দারিদ্র্য দূর করতে ভূমিব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার, জমিদারি প্রথা বিলোপ, কৃষিঋণ মুকুব, গ্রামীণ অর্থনীতি মজবুত করতে সস্তা মূলধনের ব্যবস্থা, সমবায় প্রথার বিস্তার, বৈজ্ঞানিক কৃষির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি, শিল্পায়নের ওপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ-সহ, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা স্থান পেয়েছিল।

 

হরিপুরা কংগ্রেসে দেওয়া সুভাষচন্দ্রের সভাপতির ভাষণ থেকে স্পষ্ট হল যে, প্রত্যক্ষ ভাবে সাম্যবাদী বা সমাজতন্ত্রী না হয়েও সুভাষচন্দ্র বসু ক্রমশ সেই দিকেই ঘেষছিলেন এবং সোভিয়েত রাশিয়ার সাফল্যে তিনি যথেষ্টই অনুপ্রাণিত। অমলেশ ত্রিপাঠী সঠিক ভাবেই ব্যখ্যা করেছেন যে, ‘ইন্ডিয়ান স্ট্র্যাগেলের অপরিণত চিন্তাভাবনা ইউরোপে কয়েক বছর (১৯৩৪-৩৮) কাটানোর ফলে অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। বারবার রাশিয়ার উল্লেখ, এমনকী শেষ উদ্ধৃতিতে সিপিজিবি-র উল্লেখ, ট্রেড ইউনিয়ন, কিষাণ সভা, সাম্যবাদী দলগুলির কংগ্রেসে সাময়িক যোগদানে সম্মতি, কংগ্রেস-সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন, সকল বামপন্থী শক্তিকে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে তাকে আরও গণতান্ত্রিক ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী করার আহ্বান, সবই যেন একই রাগিণীর বিচিত্র বিস্তার।‘

 

বস্তুত জওহরলাল নেহরুর লক্ষ্ণৌ কংগ্রেসে সভাপতির ভাষণের সঙ্গে (১৯৩৬) তুলনা করলে সুভাষের ভাষণকেই বেশি স্পষ্ট ভাবে বামপন্থী বলতে হবে– ‘দেশের বামপন্থী শক্তির কাছে আমার আবেদন যে তাঁরা যেন কংগ্রেসের গণতন্ত্রীকরণ এবং সাম্র্যাজ্যবাদ বিরোধী ব্যাপক মঞ্চে তাদের টেনে আনার জন্য সর্বশক্তি ও সামর্থ্য নিয়োগ করেন। ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির কার্যাবলীতে আমি সত্যিই দারুণ ভাবে উৎসাহিত… …।‘ হরিপুরায কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্র বসু সভাপতি রূপে যে ভাষণ দেন তার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য ছিল, – ১) সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় শিল্পায়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও গঠনমূলক কাজের অগ্রগতির প্রভাবে ভারতের কংগ্রেসের পক্ষ থেকে পরিকল্পনা কমিশন গঠনের প্রস্তাব, ২) কংগ্রেসেও দলকে দ্রুত পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন ও আশু গণ আন্দোলনের জন্য সাংগঠনিক ভাবে গণতান্ত্রিক ও বামপন্থী মতাদর্শে প্রস্তুত করার ডাক, ৩) অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় ১৯৩৫-এর শাসনতান্ত্রিক সংস্কার ও ফেডারেশনে বিরোধিতা। ফৈজপুরে নেহরুর থেকে এ বিষয়ে হরিপুরায় সুভাষের ঘোষণা ছিল আরও স্পষ্ট।

 

প্রকৃতপক্ষে নেহরু যে সময় দক্ষিণপন্থীদের মূলত গান্ধীর চাপে পিষ্ট হয়ে ভারত ছেড়ে ইউরোপকেই তাঁর রাজনৈতিক ক্ষেত্ররূপে বেছে নিতে চেয়েছিলেন সে সময় সুভাষচন্দ্র যে ভাবে সোশ্যালিস্ট ও কমিউনিস্টদের দু’পাশে রেখে দেশীয় রাজন্যবর্গের প্রজা দমননীতির বিরুদ্ধে সুভাষচন্দ্রের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ও দ্বিধাহীন। সুভাষচন্দ্রের এই সব কার্যকলাপ দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠী ও ব্যবসায়ী ঘনশ্যাম দাস বিড়লা প্রমুখের এ সব মোটেই ভালো লাগেনি। গান্ধীও বুঝতে পারছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু আর জওহরলাল এক রকম নন। এই সময় পর্বে কংগ্রেস সভাপতি রূপে সুভাষচন্দ্র বসু কমিউনিস্টদের কাছে আগের তুলনায় অনেক বেশি গ্রহণ যোগ্য হয়ে উঠেছিলেন। হরিপুরা কংগ্রেসকে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বামপন্থী প্রভাব প্রতিষ্ঠা করার প্রধান ক্ষেত্র রূপে দেখে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন।

 

বাংলা থেকে এআইসিসিতে মুজফফর আহমেদ ছাড়াও বঙ্কিম মুখোপাধ্যায় এবং সহ-সম্পাদকের মধ্যে পাঁচুগোপাল ভাদুড়ি এবং কমল সরকারও মনোনীত হন। তবে সংঘাতও কিছু ছিল। ১৯৩৮ সালের মে মাসে ‘ন্যাশনাল ফ্রন্টে’ সোমনাথ লাহিড়ী অভিযোগ করেছিলেন যে, বিপিসিসিতে কমিউনিস্ট (তখন রেড নামে পরিচিত) ও সোশ্যালিস্ট গোষ্ঠী তাদের সংখ্যানুপাতিক হারে কার্য নির্বাহী সমিতিতে স্থান পাননি। ‘ন্যাশনাল ফ্রন্টের মাধ্যমে আরও অভিযোগ করা হল যে, কমিউনিস্ট ও সোশ্যাললিস্টদের সমর্থন নিয়ে সুভাষচন্দ্র সভাপতিত্ব লাভ করলেও তিনি তাঁদের প্রত্যাশা পূর্ণ করতে পারেননি। হরিপুরা কংগ্রেসে উপস্থিত এবং এআইসিসি সদস্য তৎকালের তরুণ কমিউনিস্ট অধ্যাপক হীরেন্দ্র নাথমখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণকে উড়িয়ে দেওয়া যায়?

 

হরিপুরায় দেখলাম সর্দার পটেল সুভাষচন্দ্রকে আপাতদৃষ্টিতে মর্যাদা দেখালেও দিন গুনছেন তাঁকে হঠিয়ে দেওয়ার। সুযোগের অপেক্ষায় আচার্য কৃপালনী, রাজেন্দ্র প্রসাদ, গোবিন্দ বল্লভ পন্থ প্রমুখের সুকৌশল সহায়তা নিয়ে এবং স্বকীয় সমীক্ষায় স্বভাব সিদ্ধ ধূর্ততা সহকারে মগ্ন গান্ধীজির আশীর্বাদকে পুঁজি করে।‘ কমিউনিস্টরা এটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই সেই সময় বিপিসিসি-র সভাপতি সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে তাঁদের অভিমান বোধ জাগলেও তা ক্ষোভে পরিণত হয়নি। ১৯৩৮ সাল জুড়ে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত থেকে শ্রমিক কৃষক আন্দোলনকে বাদ দিলে মধ্যবিত্ত ও নগর কেন্দ্রিক যে দু’টি আন্দোলন সংগ্রামে বাংলায় বামপন্থী শক্তি সব থেকে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল সে দু’টি ছিল – ১) রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন , ২) ফেডারেশন বিরোধী আন্দোলন। বামপন্থীরা ফেডারেশনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে আন্দোলন চেয়েছিলেন।

 

কিন্তু দক্ষিণপন্থীদের কৌশলের সঙ্গে তাঁরা এঁটে উঠতে পারেননি। নীরদ সি চৌধুরির লেখা থেকে জানা যায়, ব্যক্তিগত ঝোঁকের মাথায় এই সময় সুভাষচন্দ্র সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন, যে “কংগ্রেস নেতারা ‘ফেডারেশন স্কিম’ গ্রহণ করার অভিসন্ধি রাখেন।“ অগ্রজ শরৎচন্দ্র সকালে সংবাদ পত্রে পড়ে অত্যন্ত চিন্তিত হলেন, কথাটা সত্যি কিন্তু প্রমাণ নেই। এ নিয়ে গোল সত্যই ঘটল। কংগ্রেস নেতারা অত্যন্ত ক্রুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ করলেন, বললেন, অপবাদ। বিতর্কটা গুরুতর হয়ে উঠতে বিলম্ব হল না। কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সুভাষকে সব দিক থেকে কোণঠাসা করার আয়োজন দক্ষিণপন্থীরা করেছিলেন এবং বিশেষত এই ‘অপবাদের’ অভিযোগকে কেন্দ্র করেই ১৯৩৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়বার সভাপতি নির্বাচিত সুভাষচন্দ্রের ওয়ার্কিং কমিটি থেকে দক্ষিণপন্থী নেতারা এক যোগে পদত্যাগ করলেন।

 

সুভাষচন্দ্রের একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল একরোখা বা একবগ্গা মনো ভাব। তাই সভাপতি থাকাকালীন দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে নানা বিষয়ে তাঁর আপস হয়নি। তাঁর আশঙ্কা অমূলক ছিল না যে, স্বার্থান্বেষী জমিদার ও ক্ষমতালিপ্সু কংগ্রেস নেতৃত্ব ফেডারেশনের সুযোগে সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহক ও উপনিবেশিক সংসদীয় গণতন্ত্রের ফাঁদে পা দেবেন। পূর্ণ স্বরাজের লক্ষ্য যাবে দূরে সরে। কমিউনিস্টরা অবশ্য সীমিত সামর্থ্য নিয়েই এই প্রশ্নে সুভাষচন্দ্রের পিছনে সর্বশক্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁদের ‘ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ ও ‘নিউ এজ’ মুখপত্র সেই সময় হয়ে উঠেছিল ‘ফেডারেশন’ বিরোধিতার অন্যতম প্রধান মাধ্যম। ছোটো লাট লর্ড ব্রেবোর্ন জানিয়েছিলেন, (জানুয়ারি, ১৯৩৯) যে গত নয় মাসে অন্তত ছয় হাজার সাম্রাজ্যবাদী বিরোধী মিছিল বেরিয়েছে, যার পেছনে রয়েছেন বামপন্থীরা। সুভাষচন্দ্র আলাদা ভাবে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ গঠনের আগে পর্যন্ত সন্দেহ নেই কমিউনিস্টরাও জাতীয় আন্দোলনে বিপ্লবী শক্তির প্রতিনিধিরূপে সুভাষচন্দ্রকেই মেনে নিয়েছিলেন।

 

আর ও পড়ুন    নেতাজির সঙ্গে কী হয়েছিল? সত্যিই কি তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় তিনি প্রয়াত হন?

 

হীরেন মুখোপাধ্যায়ের মতে, ১৯৩৮ সালের অক্টোবরে ন্যাশনাল ফ্রন্টই (কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন মুখপত্র) সর্বপ্রথম সুভাষচন্দ্র বসুর সভাপতির পদে পুনঃনির্বাচনের স্বপক্ষে মত প্রকাশ করেছিল। ত্রিপুরী কংগ্রেসে সোশ্যালিস্ট কমিউনিস্ট ও বামপন্থী অধ্যুষিত প্রদেশগুলি থেকেই সুভাষচন্দ্র অধিক ভোট পেয়েছিলেন। ১৯৩৯ সালের ২৫ জানুয়ারি কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী নেতারা ত্রিপুরী কংগ্রেসে সমর্থন জানিয়েছিলেন পট্টভি সীতারামাইয়া কে। কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিরা ত্রিপুরী কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্রকে অসহায় ও অসুস্থ অবস্থায় পরিত্যাগ করেননি। কমিউনিস্টরা ‘পন্থ প্রস্তাবের’ বিপক্ষে ভোট দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন তা তাঁদের পূর্বঘোষিত নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক পিসি যোশির তরফে বিবৃতি দেওয়া হয় –‘ভারতীয় কমিউনিস্টরাই প্রথম রাষ্ট্রপতি বসুর পুনঃ নির্বাচন দাবি জানিয়ে ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি বসু প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতে স্বীকৃত হইয়াছেন বলিয়া আমরা আনন্দিত……আমাদের জয় সুনিশ্চিত…’।

 

নেহরু সুভাষচন্দ্রকে সভাপতি পদের প্রার্থী হতে বারণ করেছিলেন। কমিউনিস্টরা বুঝেছিলেন যে, বাম ঐক্যে যে ভাঙন তৈরি হয়েছে তাতে মধ্যপন্থাগ্রহণ ছাড়া কংগ্রেসের ভাঙন অবশ্যম্ভাবী। সেই মধ্যপন্থা বা অফসরফায় সুভাষচন্দ্রের আপত্তি ছিল। কমিউনিস্টপার্টি ‘পন্থ প্রস্তাব’-এর বিরুদ্ধে সংশোধনী আনে ‘জাতীয় দাবি সমূহ’ বা ‘ন্যাশনাল ডিমান্ড’ প্রস্তাব উত্থাপন করে। কমিউনিস্টদের উত্থাপিত সংশোধনী প্রস্তাব পরাজিত হয়। ‘পন্থ প্রস্তাব’ বিপুল ভোটাধিক্যে ত্রিপুরীতে গৃহীত হয়। তথাপি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি ঘোষিত এই ‘প্ল্যান অব অ্যাকশন’ ছিল জাতীয় কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রায় বৈপ্লবিক।

 

ত্রিপুরী কংগ্রেসে যে ‘প্ল্যান অব ওয়ার্ক’ কমিনিস্টরা রেখেছিল পরবর্তীকালে সুভাষচন্দ্র ফরওয়ার্ড ব্লকের যে কর্মসূচি প্রনয়ণ করেন্তা ছিল এরই প্রতিলিপি। এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে হরিপুরা থেকে ত্রিপুরী কংগ্রেসের মধ্যবর্তী পর্যায়ে সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে কমিউনিস্টদের আদর্শগত সৌভ্রাতৃত্ব স্থাপিত হয়েছিল। কমিউনিজমের প্রতি আগ্রহ এবং কমিউনিস্টদের প্রতি আস্থা১৯৩৮ সালে সুভাষের মধ্যে দেখা যায়, এমনকী শ্রেণি সংগ্রামের প্রতিও তাঁর আগ্রহ বাড়ে। জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে ভারতীয় কমিউনিস্টদের পূর্বেকার বিচ্ছেদের সমালোচনা করলেও তাঁদের পর্বর্তীকালের ‘ইউনাইটেড পিপলস ফ্রন্ট’ এবং পরে ‘ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ – এর তত্ত্ব সুভাষচন্দ্রের কাছে অনেক গ্রহণযোগ্য হয়েছিল।

 

ত্রিপুরীর পর থেকে কমিউনিস্টরা সুভাষচন্দ্রের সঙ্গেই মোটামুটি ভাবে ‘লেফট কনসোলিডেশনে’ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। গোপাল হালদার প্রমুখ কয়েক জন কমিউনিস্ট সুভাষের ‘ফরওয়ার্ড’ পত্রিকার পরিচালনাতেও নিযুক্ত ছিলেন। এই সময় ন্যাশনাল ফ্রন্টেও সুভাষচন্দ্রের প্রবন্ধাদি প্রকাশিত হয়। কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে ১৯৪১ সালে সুভাষের দেশত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত ভারতীয় কমিউনিস্টরা তা৬র সঙ্গ ছাড়েননি। হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের মতো ব্যাপক ভিত্তিক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন কমিউনিস্ট ছাত্ররাও উৎসাহ সহকারে যোগদান করেছিলেন।

 

পঞ্জাবের বিপ্লবী ভগৎরাম তলোয়ারের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় যে সুভাষচন্দ্রকে নিরাপদে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার ব্যবস্থায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সেই সময় সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সুভাষচন্দ্রের ঘোষিত নীতিই ছিল দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রয়োজনে বৈদেশিক শক্তির সাহায্য লাভ। শুধু নাৎসি জার্মানি নয়, ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ইউরোপে থাকাকালীন তিনি বারবারই জার্মানি-ইতালি-জাপান এমনকী সোভিয়েত রাশিয়া তথা কমিন্টার্নের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন।দেশের বাইরে অক্ষশক্তির কাছ থেকে সুভাষচন্দ্রের সাহায্য লাভ জাতীয় কংগ্রেস অনুমোদন করেনি। কমিউনিস্ট পার্টি ও সুভাষচন্দ্রের বিচ্ছেদের সূচনাও তখন থেকেই।