সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো

সুভাষচন্দ্র

সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো। স্বাধীনতা সংগ্রামী সুভাষচন্দ্র বসু সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে ভারতকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কিভাবে তার মৃত্যু হয়েছে সেটা এখনও পরিস্কার নয়। ২৩শে জানুয়ারি তার জন্মবার্ষিকী। আজ আমরা জানব সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোতে ঠিক কি ঘটেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর পূর্ব রণাঙ্গনে জাপানি সেনাবাহিনীর মনোবল একেবারে তলানিতে ঠেকেছিল। সেই সময়েই সুভাষচন্দ্র বসু সিঙ্গাপুর থেকে ব্যাংকক হয়ে সাইগনে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু সেখান থেকে এগোনোর জন্য একটাও জাপানি বিমান ছিল না।

 

অনেক চেষ্টার পরে একটা জাপানি বোমারু বিমানে জায়গা পেয়েছিলেন তিনি। বিমানঘাঁটিতে তাকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের যেসব সহকর্মী, তাদের সঙ্গে করমর্দন করে ‘জয় হিন্দ’ বলে অভিবাদন জানিয়ে কিছুটা লাফিয়েই বিমানের সিঁড়িগুলো বেয়ে উপরে উঠে গিয়েছিলেন তিনি। তিনি বিমানে ওঠার পরেই অন্যদের ‘জয়-হিন্দ’ অভিবাদন জানিয়ে তার এডিসি কর্নেল হাবিবুর রহমানও বিমানে উঠে গিয়েছিলেন।

 

সুভাষচন্দ্র বসুর ওপরে ‘লেইড টু রেস্ট’ নামের বইটির লেখক বলছিলেন, “ওই বিমানটিতে ক্রুসহ ১৪ জন ছিলেন। পাইলটের ঠিক পিছনেই নেতাজী বসেছিলেন। তার সামনে পেট্রোলের বড় বড় জেরিক্যান রাখা ছিল। নেতাজীর পিছনেই ছিলেন কর্নেল হাবিবুর।” “বিমানে চড়ার সঙ্গে সঙ্গেই জাপানিরা নেতাজীকে সহ-পাইলটের আসনে বসার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু সেই অনুরোধ তিনি বিনম্রভাবে ফিরিয়ে দেন। ঘটনা হল, সহ-পাইলটের আসনটি তার মতো লম্বা মানুষের জন্যে বেশ ছোট ছিল,” বলেই জানিয়েছিলেন মি. রায়। তার কথায়, “পাইলট আর লেফটেন্যান্ট জেনারেল শীদে ছাড়া বাকি সকলেই বিমানের মেঝেতেই বসেছিলেন।

 

নেতাজীকে একটা ছোট কুশন দেওয়া হয়েছিল। কারও কাছেই সীট বেল্ট ছিল না।” ওই বোমারু বিমানের ভেতরে ভীষণ ঠাণ্ডা লাগছিল সবার। তখনকার দিনে যুদ্ধবিমানে এয়ার কন্ডিশনার লাগানো থাকত না। প্রত্যেক হাজার মিটার ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বিমানের তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি করে কমে যেত। ঠাণ্ডা আটকাতে সুভাষচন্দ্র বসু তার এডিসি কর্নেল হাবিবুর রহমানের কাছ থেকে তার জ্যাকেটটা চেয়ে নিয়েছিলেন। দুপুর দুটো ৩৫ মিনিটে বোমারু বিমানটি জমি ছেড়ে আকাশে উড়েছিল।

 

শাহনওয়াজ কমিশনে (বিমান দুর্ঘটনায় মি. বসুর মৃত্যু হয়েছিল কিনা সেটা খতিয়ে দেখতে ভারতের গঠিত প্রথম সরকারি কমিটি) দেওয়া সাক্ষ্যে কর্নেল হাবিবুর রহমান বলেছিলেন, “বিমান তখনও বেশি উপরে ওঠে নি। বিমানঘাঁটির চৌহদ্দির মধ্যেই ছিল। সেই সময়েই বিমানের সামনের দিকে একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই। পরে জেনেছিলাম বিমানের একটা প্রোপেলার ভেঙ্গে নীচে পড়ে গেছে। বিমানটা নীচে পড়ে যেতেই সামনের দিকে আর পেছনের দিকে আগুন লেগে গিয়েছিল।” “বিমান ভেঙ্গে পড়তেই নেতাজী আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। আমি তাকে বলেছিলাম, সামনের দিক দিয়ে বের হওয়ার জন্য।

 

আর ও পড়ুন    নেতাজির সঙ্গে কী হয়েছিল? সত্যিই কি তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় তিনি প্রয়াত হন?

 

পেছনের দিকে যাওয়ার জায়গা নেই। সামনের দিকেও আগুন জ্বলছিল। তার মধ্যে দিয়েই তিনি বাইরে বেরিয়ে যান। কিন্তু তিনি যেখানে বসেছিলেন, তার সামনে রাখা পেট্রল ভর্তি জেরিক্যান থেকে তেল বেরিয়ে তার কোট পুরো ভিজে গিয়েছিল,” শাহনওয়াজ কমিশনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে জানিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ সহযোগী কর্নেল হাবিবুর রহমান। তিনি আরও বলেছিলেন, “আমি বাইরে এসেই দেখি নেতাজী ১০ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। পশ্চিমের দিকে তাকিয়েছিলেন তিনি। ততক্ষণে তার পোশাকে আগুন লেগে গেছে।

 

আমি তার দিকে দৌড়ে গিয়ে অনেক চেষ্টার পরে তার ‘বুশর্ট বেল্ট’টা খুলতে পারলাম। তারপরে তাকে মাটিতে শুইয়ে দিই আমি। তার মাথার বাঁদিকে প্রায় ৪ ইঞ্চি লম্বা একটা গভীর ক্ষত।” “একটা রুমাল দিয়ে ওই ক্ষত থেকে রক্তপাত বন্ধ করার চেষ্টা করছিলাম। তখনই নেতাজী আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমার বেশি চোট লাগে নি তো?’ বলেছিলাম যে আমি ঠিক আছি,” জানিয়েছিলেন কর্নেল রহমান। “উনি বলেছিলেন মনে হচ্ছে আমি আর বাঁচব না। আমি ভরসা দিয়েছিলাম, ‘আল্লাহ আপনাকে বাঁচাবে’।

 

তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে না। দেশে ফিরে গিয়ে সবাইকে জানিও যে আমি শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলাম। তারা যেন এই লড়াই জারি রাখে। ভারত নিশ্চয়ই স্বাধীন হবে,” এভাবেই সেই ঘটনার বিবরণ দিয়েছিলেন তিনি। দশ মিনিটের মধ্যেই উদ্ধারকারী দল বিমানঘাঁটিতে পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু তাদের সঙ্গে কোনও অ্যাম্বুলেন্স ছিল না। তাই সুভাষচন্দ্র আর বাকি আহতদের সেনাবাহিনীর একটা ট্রাকে করেই তাইহোকু সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মি. বসুকে প্রথম যে চিকিৎসক পরীক্ষা করেছিলেন, তার নাম ছিল ডাক্তার তানইয়াশি ইয়োশিমি।