ফ্রান্স ফটোগ্রাফার মার্ক রিবু’র ও সত্যজিৎ

ফ্রান্স ফটোগ্রাফার মার্ক রিবু’র ও সত্যজিৎ। মার্ক রিবুর ছবি আমি প্রথম দেখি ১৯৮৪ সালে। ‘এক্ষণ’ পত্রিকায় অপরাজিত ছবির স্ক্রিপ্ট ছাপা হবে। প্রায় রোজই সম্পাদক, নির্মাল্য আচার্যের সঙ্গে দেখা হয়। চিত্রনাট্যের সঙ্গে আর কী যেতে পারে সেই সব নিয়ে নানান কথা বলেন। এমনই একটা সময়ে নির্মাল্যবাবুর কাছে অপরাজিত বিষয়ক কয়েকটি ফটোগ্রাফের ব্রোমাইড প্রিন্ট দেখি। তারমধ্যে একটি ছিল ছবির শুটিংয়ের। ক্যামেরায় চোখ দিয়ে সুব্রত মিত্র,পাশে ঘামে ভেজা পাঞ্জাবি গায়ে সত্যজিৎ রায়। পিছনে অনিল চৌধুরীও দাঁড়িয়ে আছেন। শিয়ালদহ স্টেশনে শুটিংয়ের ওয়ার্কিং স্টিল । ছবিটি পাওয়া গিয়েছিল সন্দীপ রায়ের কাছ থেকে। সন্দীপই জানিয়েছিলেন ছবিটি বিখ্যাত ফটোগ্রাফার মার্ক রিবুর তোলা।

 

রিবুর সম্বন্ধে আর কিছুই জানতাম না। পরে আরও কয়েকটি ছবি দেখি।অসাধারণ ছবি। রিবুর সম্বন্ধে খোঁজখবর নিই। জানতে পারি তিনি ফরাসী ফটোগ্রাফার। ক্যামেরার প্রতি প্রেম ছিল কিশোর বয়স থেকে। শুধু ফটোগ্রাফিকে ভালোবেসে মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে দুই প্রিয় বন্ধু কার্তিয়ের ব্রেঁসো আর রবার্ট কাপার আমন্ত্রণে ম্যাগনামে যোগ দেন।
রিবু বলতেন, ‘ছবি তোলা তাঁর কাছে চোখ দিয়ে দেখা,শ্বাস প্রশ্বাস নেবার মতোই। গায়ক যেভাবে গুন গুন করেন,আমিও সেভাবেই ছবি তুলি।’

 

তিনি বলতেন,’ছবি তোলা মানে এক সেকেণ্ডের প্রতি ১-এর ১০০ তম ভাগে জীবনকে চরম উপভোগ করা।’ ১৯৫৫ -৫৬ সালে তিনি ভারতসহ মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়া ভ্রমণ করেন।তুরস্ক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান হয়ে ভারতে এসেছিলেন। এখান থেকে শান্তিনিকেতন, পুরী, দার্জিলিং, ইম্ফল, বেনারস, খাজুরাহো,লখনৌ,আগ্রা,দিল্লি,জয়পুর,যোধপুর, চণ্ডীগড়, অমৃতসর হয়ে আবার কলকাতা ফিরে আসেন। এখান থেকে নেপাল এবং পরে চিনে গিয়েছিলেন।কলকাতায় থাকার সময় বন্ধু পরিতোষ সেন তাঁকে সত্যজিতের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন। তিনি শুনেছিলেন শিয়ালদহ স্টেশনে সত্যজিৎ রায় শুটিং করার কথা। শুটিংয়ের দিনে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন শিয়ালদহ স্টেশনে।

 

ব্যাপারটা জেনে বিস্মিত হয়েছিলাম,সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবিটাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সে এতটাই সুখ্যাতি লাভ করে যে, ম্যাগনামের অন্যতম ফটোগ্রাফার একটা গোটা দিন শুটিংয়ের আউটডোরে কাটিয়ে দিলেন। শুটিংয়ের সেই ঘটনাবহুল সময়টাকে তিনি ধরে রেখেছিলেন তাঁর ক্যামেরায়।
রিবুর সেই আউটডোর শুটিংয়ে তোলা ছবির কনট্যাক্ট শিটটা দেখা গেল ফ্রান্স- ভারতের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘কনভারজেন্স’ নামে এক প্রদর্শনীতে। ভারতে ফটোগ্রাফির ফরাসী সংযোগ নিয়ে এই প্রদর্শনী। রিবুর ফটোগ্রাফের মূল অংশটা সংরক্ষিত আছে প্যারিসের মিউজি গিমেতে। সেখান থেকেই বাছাই ছবি নিয়ে এই প্রদর্শনী।

আরও পড়ুন – মহার্ঘ্যভাতা অবিলম্বে প্রদানের দাবি তুলে শিলিগুড়ি মহকুমা শাসকের দফতরে অভিযান

তবে আমার মনে হয়, এই দিনটা ছাড়াও তিনি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে একদিন বোড়ালে শুটিং স্পটও দেখতে যান। রিবুর তোলা বোড়ালে সত্যজিৎ রায়ের ছবি এই প্রদর্শনীতে না থাকলেও আমি দেখেছি। শুধু ঘটনার সাক্ষী হয়ে ছবি তোলা নয়,তাঁর আলো-ছায়ার কাব্যিক আবেদনের সঙ্গে সঙ্গে রূঢ় রুক্ষ বাস্তব এবং একই সঙ্গে বিমূর্তায়নও ধরা দেয় তাঁর ছবিতে। সত্যজিতের ঘামে ভেজা পাঞ্জাবিতে আমাদের বুঝিয়ে দেয় শুটিংয়ের পরিশ্রমজনিত বাস্তব। অপরাজিত ফিল্মে দেখা যাবে ট্রেনটি শিয়ালদহ স্টেশনে এসে থামার পর অপু ট্রেন থেকে নেমে এগিয়ে চলেছে।এবং এটা জেনে আরও বিস্মিত হবেন ফিল্মে মাত্র ১০ সেকেণ্ডের এই দৃশ্যটি তোলার জন্যে সত্যজিৎ এবং তাঁর ইউনিটের একটি দিন লেগেছিল। মার্ক রিবু সেই আশ্চর্য পরিশ্রমী ঘোর বাস্তব দিনটি আমাদের আবার ফিরিয়ে দিলেন।

 

তবে দুই ঘর জোড়া এই গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনীর একটি প্যানেল শুধু সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে।বাকিগুলিতে বিভিন্ন জায়গার আরও মূল্যবান সব ছবি রয়েছে। রয়েছে অন্য ফটোগ্রাফারদেরও ছবি এবং বিস্তারিত আলোচনা। যাঁরা ফটোগ্রাফি ভালোবাসেন তাদের কাছে এই এক্সিবিশনটা অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলা যেতে পারে এটি হতে পারে লাইফটাইম অভিজ্ঞতা। ভারতীয় যাদুঘর-এর মেইন বিল্ডিংয়ের দোতলায়। চলবে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
সকাল ১০টা – সন্ধ্যা ৬টা। সোমবার বন্ধ। এই ধরনের প্রদর্শনীর আয়োজন মিডিয়া জগতে সুখবর এনে দিয়েছে, একথা নিশ্চিতকরে বলা যায়।