এবার পুজোয় ঘুরে আসুন বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন থেকে

এবার পুজোয় ঘুরে আসুন বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন থেকে

Facebook
Twitter
LinkedIn
Email
WhatsApp
Print
Telegram
ক্যানিয়ন

এবার পুজোয় ঘুরে আসুন বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন থেকে । শীলাবতী নদীর পাশে অবস্থিত এই অঞ্চলটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কোনও অংশেই কম নয়।গড়বেতা স্টেশনের অদূরে গনগনি। সপ্তাহান্তে ভ্রমণের আদর্শ জায়গা। প্রকৃতিই এখানে শিল্পী। তার আপন খেয়ালে সেজে উঠেছে শিলাবতী নদীর তীরে গড়বেতার অন্যতম পর্যটনস্থল গনগনি।

 

এই গনগনিকে ঘিরে রয়েছে এই অঞ্চলের লোককাহিনি, রয়েছে ইতিহাস।এখানকার মানুষজনের সঙ্গে আলাপ করলে তাঁরা আপনাকে মহাভারতের বকরাক্ষসের কাহিনিটা বলবেই। সেই ইতিহাসের শিকড় পৌরাণিক যুগে মহাভারত অব্দি বিস্তৃত। অজ্ঞাতবাসে থাকার সময় পঞ্চপাণ্ডব এখানে নাকি কিছু দিন কাটিয়েছিলেন। পাণ্ডবরা বনবাসে থাকাকালীন একদিন এসে পড়েছিলেন এই গনগনিতে।

 

এই তল্লাটে তখন দাপিয়ে বেড়াত বকাসুর নামের রাক্ষস। কোনো একজন গ্রামবাসীকে রোজ তার হাতে তুলে দিতে হত নৈবদ্য হিসেবে। এর অন্যথা হলে, সমস্ত গ্রাম তছনছ করে ছাড়তো বকাসুর। পাণ্ডবরা এইখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন এক ব্রাহ্মণ পরিবারে। বকাসুরের খাদ্য হিসেবে উৎসর্গ হওয়ার জন্য একদিন সময় এলো এই পরিবারের। মাতা কুন্তীর নির্দেশে ভীম এই পরিবারের সদস্য হয়ে নিবেদিত হলো বকাসুরের কাছে।

 

শুরু হলো প্রবল যুদ্ধ বকাসুরের সাথে শক্তিশালী ভীমের। অবশেষে ভীমের হাতেই বধ হলো বকাসুর। তাদের যুদ্ধের প্রতাপে এখানকার মাটি কেঁপে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, শিলাবতীর এই গিরিখাত আসলে বকরাক্ষস আর ভীমের মধ্যে যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয়েছিল তার ফলেই তৈরি হয়েছিল।এতো গেলো পৌরাণিক কাহিনী।

 

আর ও  পড়ুন  ফের বেআইনিভাবে নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করেছে চিন

 

চুয়াড় লায়েক বিদ্রোহ তো বেশি দিনের কথা নয়। মোটামুটি দু শো বছর আগের। বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক অচল সিংহ তাঁর দলবল নিয়ে আস্তানা গেড়েছিলেন গনগনির গভীর শালবনে। রপ্ত করেছিলেন গেরিলা লড়াইয়ের কলাকৌশল। ইংরেজদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলেন।ইংরেজ বাহিনী নাকি কামান দেগে গোটা শালবন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তবু দমানো যায়নি অচলকে। চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে যান তিনি। অবশ্য শেষরক্ষা করতে পারেননি। বগড়ির শেষ রাজা ছত্রসিংহ ধরিয়ে দেন অচলদের। এই গনগনির মাঠেই নাকি অচল ও তাঁর সঙ্গীদের ফাঁসি দিয়েছিল ইংরেজরা।

 

নিসর্গের নিরিখেই এই এলাকাটিকে ‘বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’ বলেন বহু পর্যটক। পর্যটকদের আনাগোনা বাড়তেই গনগনিকে পর্যটন কেন্দ্রের রুপ দিতে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে রাজ্য পর্যটন দপ্তর। শিলাবতী নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকা বাংলার একমাত্র গিরিখাদ গনগনি।

 

শিলাবতী নদী, ছোটনাগপুরের মালভূমিতে উৎপত্তি শিলাবতি নদীর, পুরুলিয়ার পুঞ্চা শহরের কাছে। সেই শিলাবতী নদী পুরুলিয়া, বাঁকুড়া আর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার উপর দিয়ে বয়ে গেছে। ঘাটালের কাছে জোট বেঁধেছে দ্বারকেশ্বরের সঙ্গে। এই ছোট্ট শিলাবতী প্রায় সারা বছর গা এলিয়ে শুয়ে থাকে, অত্যন্ত রুগ্ন, শীর্ণ চেহারা তার। কিন্তু বর্ষা এলেই তার রুদ্র রূপ, ভাসিয়ে দেয় চন্দ্রকোনা, ক্ষীরপাই আর ঘাটাল।

 

এহেন শিলাবতীর কেরামতিতে সৃষ্টি এই গনগনির গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। এই গনগনিতেও শিলাবতীর সেই পরিচিত রূপ,গনগনি আজ থেকে প্রায় ২ মিলিয়ন থেকে দশ হাজার বছরের মধ্যবর্তী সময়ের সঞ্চিত কাঁকুরে পলল স্তরের ওপর দীর্ঘ সময় ধরে ক্রমান্বয়ে ঋতুগত ভৌমজলস্তরের ওঠা নামার ফলে আদ্রতা ও শুষ্কতার প্রভাবে তৈরি হওয়া ল্যাটেরাইটের প্রকাশ।

 

শিলাবতী নদীর ডানদিকের পাড় বরাবর দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় ৩০ মিটার উঁচু এই ডাঙার খাড়া ঢাল বরাবর গভীর ক্ষয়ের ফলে সৃষ্ট অজস্র ছোট ছোট নালা এবং নালাগুলির সংযুক্তির ফলে সৃষ্টি হওয়া অসংখ্য গালির সমন্বয়ে এই ক্ষয়িষ্ণু ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। গড়বেতা শহরটি বেশ উঁচু। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে শিলাবতী নদী। বর্ষায় ফুলে ফেঁপে ওঠা নদী গিয়ে আছড়ে পড়ে পাশের উঁচু টিলায়। পাশাপাশি বৃষ্টিতেও ভূমিক্ষয় হয়। সেই ভূমিক্ষয় থেকেই তৈরি হয়েছে ছোট ছোট টিলা, গর্ত, খাল। তাতে আবার রঙের বৈচিত্র্য। কোথাও সাদা, কোথাও লালচে বা ধূসর।

 

কোনও অংশ দেখে আবার মনে হবে যেন মন্দির, আবার কোনও অংশ মনুষ্য আকৃতির, কোথাও বা টিলা গুহার আকার নিয়েছে। ভূগোলের ছাত্রছাত্রী থেকে গবেষক, ভূমিক্ষয় নিয়ে গবেষণার জন্য অনেকেই এখানে আসেন। আর ভ্রমণ পিপাসু মানুষ আসেন ভূমিক্ষয়ের ফলে তৈরি প্রকৃতির শিল্পকর্ম দেখতে ।

 

শিলাবতীর তীরে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের মুহূর্তে গনগনির রূপ খুবই মোহময়ী। গড়বেতা স্টেশন থেকে যে রাস্তা হুমগড়ের দিকে গেছে, সেই পথে খানিক গিয়ে ডান দিকে গনগনি। বোর্ডে পথনির্দেশ দেওয়া। লাল মাটির রাস্তা পৌঁছে দিয়েছে চুয়াড় বিদ্রোহ খ্যাত গনগনির মাঠে। সামাজিক বনসৃজনের ফসল কাজু আর শাল-পলাশের বন দু’ পাশে রেখে এখানে আসতে আসতে বেলা অনেকটা গড়িয়ে গেল। শীতের সূর্য পশ্চিমে হেলেছে কিছুটা।

 

অকুস্থলে আসতেই চোখের ফ্রেমে বন্দি হল এক আশ্চর্য ভূমিরূপ, প্রকৃতির শৌর্য আর খেয়ালিপনার এক বিস্ময়কর নিদর্শন। মনুষ্যকৃত সৃষ্টি গুলোকে যতই পৃথিবীর আশ্চর্য বস্তু বলে তকমা দিই না কেন, প্রকৃতির সৃষ্টির কাছে সে সব হার মানতে বাধ্য। মুহূর্তে মনে হল, সত্যিই তো, আমাদের গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন নেই তো কী হয়েছে, গনগনি তো আছে। সার্থকনামা গনগনি। শীতের দুপুরে গনগনি যেন সত্যিই রঙের লাবণ্যে গনগন করে। গোটা এলাকাটা রক্তিম আভায় জ্বলছে। প্রকৃতিতে এখন রঙের ফোয়ারা। আকাশ রয়্যাল ব্লু, গিরিখাতে হরেক শেডের লাল, তার ওপর সবুজ ঘাসের পরত। শিলাবতীর সবুজ নীল জল আর হলুদ বালুতট, দু পারে সবুজের ঘেরাটোপ, আলু চাষের জমি। রঙের এই অদ্ভুত বাহারিয়ানা।

 

লম্বায় দেড় দু কিলোমিটার তো হবেই। ল্যাটেরাইট শিলায় তৈরি এই ভূখণ্ড। যুগ যুগ ধরে চলেছে প্রকৃতির খেলা। শিলাবতী আজ শীর্ণ, কিন্তু চিরকাল তো তার এই রূপ ছিল না। তার জলোচ্ছ্বাস ল্যাটেরাইট শিলায় আঘাত করেছে নিয়মিত। প্রবল ঝড় বাতাস বয়ে গেছে এই মাঠ দিয়ে। ফলে সময়ের প্রবাহে তৈরি হয়েছে নানা প্রাকৃতিক ভাস্কর্য। সেই সব ভাস্কর্য আমাদের কল্পনায় নানা রূপ পেয়েছে। কেমন সে সব রূপ ? ভালো ভাবে বোঝার জন্য বাঁধানো রঙিন সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে হয়। শিলাবতীর পাড় ধরে এগিয়ে চলা। নজর ডান দিকে। কখনও মনে হচ্ছে এখানে একটা দুর্গ ছিল। সেই দুর্গ আজ ধ্বংস, রয়ে গেছে তার প্রাচীর। এখানে ওখানে প্রচুর গহ্বর। কোনও কোনও জায়গায় ভূমিখাত এমন রূপ নিয়েছে, যেন মনে হচ্ছে বাড়ি বা মন্দিরের থাম বা দালান। এই গিরিখাতের দেওয়ালে দেওয়ালে যে রূপ তৈরি হয়েছে তা কোথাও যেন দুর্গা, কোথাও বা শিব, কোথাও আবার ডাইনোসর, তো কোথাও বুনোমোষ। মানুষও আছে। অভিনব, অসামান্য সব কারুকলা ! তাই এবার পুজোয় ঘুরে আসুন এই গনগনি থেকে।

RECOMMENDED FOR YOU.....

Scroll to Top